1. mahfujpanjeree@gmail.com : Mahfuzur-Rahman :
  2. admin@samagrabangla.com : main-admin :
  3. mahmudursir@gmail.com : samagra :

কর্ড ব্লাড কি? কর্ড ব্লাড সংগ্রহ করা হয় কেন?

  • Update Time : বৃহস্পতিবার, জুন ১১, ২০২০

কর্ড ব্লাড কি? কর্ড ব্লাড সংগ্রহ করা হয় কেন? একে কীভাবে সংরক্ষণ করা হয়? কর্ড ব্লাড স্টেম সেলের বৈশিষ্ট্য কি?

নাড়ির টান যে কত গভীর তা তো সাহিত্যের বিষয় হয়ে নানা ভাবে প্রকাশ পেয়েছে, কিন্তু নাড়ির রক্তেরও যে এত ক্ষমতা তা কিন্তু জানা গেছে মাত্র কিছুদিন আগে। আর তা প্রমাণ করেছেন চিকিত্সা বিজ্ঞানীরা।

কোনও মহিলা যখন গর্ভবতী হন তখন নাভিরজ্জু বা আম্বিলিক্যাল কর্ডের মাধ্যমেই তাঁর সঙ্গে গর্ভস্থ শিশুর যোগাযোগ রচিত হয়। নাভিরজ্জু তাই আসলে মা ও শিশুর মধ্যে লাইফলাইন হিসেবে বিবেচিত হয়। এই পথেই মায়ের শরীর থেকে সন্তানের শরীরে পুষ্টি, অক্সিজেন ও অন্যান্য জৈবিক উপাদান স্থানান্তরিত হয়। এই পথে শিশুর জন্য স্টেম সেলের মতো অতি প্রয়োজনীয় আরও কিছু উপাদানও পরিবাহিত হয়। স্টেম সেলকে অনেকে সাদা পাতার সঙ্গে তুলনা করেন। শিশুর শরীরের নানা অঙ্গে পৌঁছে গিয়ে এই কোষগুলি সেখানকার কোষের সঙ্গে যুক্ত হয়ে ঠিক সেই অঙ্গের জন্য প্রয়োজনীয় গল্পটা নাকি লিখে নেয়। এমনটাই দাবি করেন তাঁরা।

কেন সংরক্ষণ

চিকিৎসাশাস্ত্রের অন্যতম একটি শাখার নাম পুনরুজ্জীবনমূলক বা রিজেনারেটিভ মেডিসিন। এই শাখায় শরীরের অঙ্গ প্রত্যঙ্গগুলিকে পুনরায় জন্ম দানের সাহায্যে রোগ সারানো হয়। এই বিষয়ের গবেষণারত বিজ্ঞানী কিংবা চিকিৎসকেরা এই স্টেম সেলের মধ্যে দারুণ কিছু সম্ভাবনা খুঁজে পেয়েছেন। ‘সম্ভাবনা’ কথাটা ভাল করে খেয়াল করে দেখুন। হবেই যে এমন কিন্তু বলা যাচ্ছে না। আর তাই এ বিষয়ে বর্তমান প্রযুক্তি এখনও অনেকটা অপরিণত অবস্থায় আছে।

তাঁরা মনে করেন, সন্তান প্রসবের পরে একবার এই নাভিরজ্জু ও তার ভেতরের রক্তকে (কর্ড ব্লাড) বাতিল করে নষ্ট বলে ফেলে দেওয়া হলে একই সঙ্গে কিছু দুর্মূল্য সেলকেও নষ্ট করে ফেলা হবে। আসলে এটা ভুললে চলবে না যে, কর্ড ব্লাডের মধ্যে মায়ের শরীর থেকে শিশুর জন্য তৈরি হওয়া স্টেম সেলও থাকে। তাই কোনও শিশুর কর্ড ব্লাড সংরক্ষণ করলে সেটি শিশুটির হুবহু সাদৃশ্যযুক্ত কোষের একটি নিশ্চিত উত্স হয়ে থাকবে। কোনও দুর্ভাগ্যজনক পরিস্থিতিতে (যেমন, জীবনদায়ী কোনও রোগ) এই উত্স শিশুটির জীবন বাঁচানোর ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে। এর জন্য যা করতে হবে তা হল কোনও নির্দিষ্ট হাসপাতালে এই কর্ড ব্লাড নিয়ে গিয়ে সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা।

এই বিষয়ে ডাঃ হ্যাল ব্রক্সমেয়ার-সহ ডাঃ এডওয়ার্ড এ বয়েস ন্যাশনাল অ্যাকাডেমি অফ সায়েন্সের কার্যবিবরণীতে লেখেন যে, জন্ম মুহূর্তে আম্বিলিক্যাল কর্ড থেকে রক্ত সংগ্রহ করে সেটিকে কোনও গবেষণাগারে নিয়ে গিয়ে ভবিষ্যৎ ব্যবহারের জন্য ক্রায়োপ্রিজার্ভ করা সম্ভব। উল্লেখ্য, ইমিউনোলিজতে পথিকৃত হিসেবে ডাঃ বয়েস-এর নাম করতে হয়।

যেভাবে সংগ্রহ

কর্ড ব্লাড সংগ্রহ করা খুব সহজ। শিশু জন্মানোর ঠিক পরে এই নমুনা সংগ্রহ করা হয়। প্রসবের ঠিক পরে গর্ভফুল বা প্ল্যাসেন্টার সঙ্গে যুক্ত আম্বিলিক্যাল কর্ডটি বিচ্ছিন্ন করার পর প্ল্যাসেন্টা থেকে একট সূচের সাহায্যে ১০০ থেকে ১৫০ মিলি পরিমান রক্ত একটি পাত্রে ভরে নেওয়া হয়। তবে সংগ্রহের আগে ১-২ মিনিট অপেক্ষাও করা যেতে পারে। অপেক্ষার উদ্দেশ্য সদ্যোজাত শিশু যাতে গর্ভফুল বা প্ল্যাসেন্টা থেকে আরও কিছুটা রক্ত গ্রহণ করে নিতে পারে। বোঝাই যাচ্ছে, গোটা ব্যাপারটি খুব সামান্য একটি পদ্ধতি। সম্পূর্ণ প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন হতে তাই মিনিট পাঁচেকের বেশি সময় লাগবে না।

ক্ষতি হয় না

বলা বাহুল্য, এই পদ্ধতি বেদনাহীন এবং এতে বিন্দুমাত্রও ঝুঁকির সম্ভাবনা নেই। প্রকৃতপক্ষে এই পদ্ধতি এতটাই দ্রুত ও যন্ত্রণামুক্ত যে অধিকাংশ ক্ষেত্রে মা বুঝতেই পারেন না কখন কর্ড ব্লাড সংগ্রহ করা হয়ে গেছে। আর সে কারণেই কর্ড ব্লাড সংগৃহীত হলে মা ও সদ্যোজাত সন্তান কারোরই কোনও ক্ষতির সম্ভাবনা নেই। তা ছাড়া এই নমুনাটি না নেওয়া হলে আগেকার দিনের মতো তো সেটাকে ফেলেই দেওয়া হত।

যেভাবে সংরক্ষণ

কর্ড ব্লাড সংরক্ষণ করতে হয়ে হয় ক্রায়োপ্রিজাভেশনের মাধ্যমে। অর্থাৎ, রক্তটাকে যতখানি সম্ভব ঠান্ডায় সংরক্ষণ করে রাখা হয়। এই উদ্দেশ্যে সংগৃহীত রক্তের নমুনা ব্যাঙ্কে পাঠানো হয়। সেখানে প্রথমে মায়ের রক্তে কোনও সংক্রমণ আছে কিনা তা পরীক্ষা করে দেখে নেওয়া হয়। হিউম্যান লিউকোসাইট অ্যান্টিজেন (এইচ এল এ) টাইপিং নামের একটা পরীক্ষাও করা হয়। সেই সঙ্গে কর্ড ব্লাডটিকে পরীক্ষা করে দেখা হয় তাতে কোনও বংশানুক্রমিক রোগ আছে কিনা। সব হয়ে যাওয়ার পরে রক্তের নমুনাটিকে ধীরে ধীরে ঠান্ডা করে তরল নাইট্রোজেনে সংরক্ষণ করে রাখা হয়।

তবে কয়েকটি ক্ষেত্রে সংরক্ষণ বাতিল হয়ে যেতে পারে। যেমন, মা বা পরিবারের সদস্যদের কারও কোনও রোগের ইতিহাস থাকলে, রক্তের পরিমান কম হলে এবং অন্য কয়েকটি কারণে।

ফিরে দেখা
১৯৮৮ সালের অক্টোবর মাসে প্যারিসের সেন্ট ল্যুইস হসপিটালে চিকিত্সাবিজ্ঞানের এক নতুন
অধ্যায়ের সূচনা হয়। ওই দিন দুরারোগ্য ফ্যানকোনি অ্যানিমিয়া রোগে আক্রান্ত ম্যাথিউ ফ্যারো নামে
একটি পাঁচ বছরের শিশুর শরীরে বিশ্বের প্রথম কর্ড ব্লাড প্রতিস্থাপন করা হয়। দাতা ছিল ম্যাথিউ-র
সদ্যোজাত বোন। জন্মমুহূর্তে তার কর্ড ব্লাড সংরক্ষণের কাজটি করে রেখেছিলেন আমেরিকার বৈজ্ঞানিক ডাঃ হ্যাল ব্রক্সমেয়ার। এই যুগদর্শী ঘটনা বাস্তবিক পক্ষে একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলন হয়ে উঠেছিল।
ফরাসী চিকিত্সক, যিনি অস্ত্রোপচারে কাজটি করেন তাঁর নাম ছিল ডাঃ এলিয়ান গ্লুকম্যান এবং ম্যাথিউ ছিল আমেরিকার নর্থ ক্যারোলাইনার অধিবাসী। আজ ম্যাথিউ সম্পূর্ণ সুস্থ একজন বিবাহিত পুরুষ এবং দায়িত্বশীল পিতা।

কর্ড ব্লাডে যা থাকে

এই রক্তে হেমাটোপোয়েটিক সেল-সহ নানা ধরনের স্টেম সেল থাকে। অপরিণত হেমাটোপোয়েটিক সেল ও স্টেম সেলগুলির কিছু বিশেষ বৈশিষ্ট্য আছে। রক্ত ও সুরক্ষা ব্যবস্থার প্রয়োজনে এরা মানবদেহের যে-কোনও ধরনের কোষে পরিবর্তিত হওয়ার ক্ষমতা রাখে। তাই এদের সাহায্যে হেমাটোপোয়েটিক ও জেনেটিক রোগ ছাড়াও ভবিষ্যতে অনেক কঠিন রোগের চিকিত্সা সম্ভব বলে মনে করা হচ্ছে। রক্তের বিশৃঙ্খলায় ভুগছেন এমন রোগীদের শরীরেও এদের প্রতিস্থাপিত করা যায়।

সংরক্ষিত হলে

সংরক্ষণের সাহায্যে এই স্টেম সেলগুলির বৃদ্ধিকে থামিয়ে রাখা হয়। অর্থাৎ এরা যেমন ছিল তেমন অবস্থাতেই থাকে। সেই সঙ্গে এদের বিভিন্ন টক্সিন ও ভাইরাস থেকেও রক্ষা করা হয়।

কতদিন সংরক্ষিত থাকতে পারে

কর্ড ব্লাড সংরক্ষণ প্রায় ৪০ বছর আগে শুরু হয়েছিল এবং এই নমুনা ১০ বছরেরও বেশী সময় ধরে সংরক্ষণ করে রাখার পর ব্যবহার করার উদাহরণ আছে। তবে বিজ্ঞানীরা বলে থাকেন, তরল নাইট্রোজেনে রেখে ঠিক মতো ফ্রিজিং করে যদি এই সংরক্ষণ করা যায়, তাহলে বহু বছর বা বলা যায় চিরজীবনের জন্য কর্ড ব্লাড সংরক্ষণ করা সম্ভব।

স্টেম সেল কি শুধুই কর্ড ব্লাডে?
স্টেম সেল শুধু কর্ড ব্লাডেই থাকে এমন নয়। কর্ড ব্লাড ছাড়াও স্টেম সেল বোন ম্যারো, পেশি, চর্বি, চুলের গ্রন্থি, শিশুর দাঁত ও পেরিফেরাল ব্লাডে পাওয়া যায়। তবে এই স্টেম সেলগুলির গুণগত মান ততটা ভাল হয় না।

কর্ড ব্লাড স্টেম সেলের বৈশিষ্ট্য

কর্ড ব্লাড অনেক মারাত্মক মারণ রোগের চিকিত্সায় ব্যবহার করা যায়। চিকিত্সার কারণে বোন ম্যারো থেকে যে স্টেম সেলগুলিকে অন্য দেহে প্রতিস্থাপিত করা হয় তারই বিকল্প হিসেবে চিকিত্সকেরা বর্তমানে তাই কর্ড ব্লাড ব্যবহারের ওপরে বেশি জোর দিচ্ছেন। এদের কিছু বৈশিষ্ট্যের কথা নিচে জানানো হল-

  • অতি সহজে সংগ্রহ করা যায়: জীবনের একটি বিশেষ মুহূর্তে হলেও কর্ড ব্লাড অতি সহজেই সংগ্রহ করা যায়। তুলনামূলক ভাবে স্টেম সেলের অন্যতম ভিন্ন উত্স বোন ম্যারো থেকে স্টেম সেল সংগ্রহ করতে গেলে জেনারেল অ্যানাস্থেশিয়ার সাহায্য নিয়ে কাটা-ছেঁড়া করতে হয়। তাতে কিছু অভ্যন্তরীন ঝুঁকিও থেকে যায়। এই ধরনের কোনও ঝুঁকি কর্ড ব্লাড সংগ্রহের ক্ষেত্রে থাকে না।
  • কমবয়সী ও নমনীয়: জীববিজ্ঞানের নিরিখে কর্ড ব্লাড স্টেম সেল, অন্য উত্সের (যেমন, বোন ম্যারো স্টেম সেল) প্রাপ্তবয়স্ক স্টেম সেলের তুলনায় বয়সে নবীন এবং বেশি নমনীয়। অপরিণত থাকে বলে অন্য ব্যক্তির শরীরে এদেরকে প্রতিস্থাপন করা অনেক সহজ
  • ঝুঁকি কম: কর্ড ব্লাড প্রতিস্থাপনের সময় অন্য স্টেম সেল প্রতিস্থাপনের তুলনায় ঝুঁকির সম্ভাবনা অনেক কম থাকে।
  • ভাল মানের, পুনর্গঠন ক্ষমতাও বেশি: সদ্যোজাত শিশুর কর্ড ব্লাডে যে স্টেম সেল পাওয়া যায় তা বোন ম্যারো থেকে সংগ্রহ করা স্টেম সেলের নমুনা থেকে অনেক উচ্চমানের হয়। তাদের পুনর্গঠন ক্ষমতাও থাকে অনেকটাই বেশি।
  • প্রতিস্থাপনকালীন সুবিধে বেশি: প্রতিস্থাপনের সময় কর্ড ব্লাডে থাকা স্টেম সেল থেকে বোন ম্যারো স্টেম সেলের তুলনায় অনেক বেশি সুবিধে পাওয়া যায়।
  • এনগ্রাফমেন্ট হার বেশি: কর্ড ব্লাড স্টেম সেলের এনগ্রাফমেন্ট হার অনেক বেশি তার ফলে প্রতিস্থাপিত সেল গ্রহীতার শরীরে অনেক বেশি সংখ্যায় বিভাজিত হয়। তাতে শেষপর্যন্ত গ্রহীতা উপকৃত হয়।
  • পোস্ট–ট্র্যান্সপ্লান্ট গ্র্যাফ্ট বনাম হোস্ট ডিজিজ কম: এইচ এল এ বা হিউম্যান লিউকোসাইট অ্যান্টিজেনের বৈসাদৃশ্যের ক্ষেত্রে কর্ড ব্লাড স্টেম সেল বোন ম্যারো প্রতিস্থাপনের তুলনায় অনেক বেশি সহনশীল। এই বৈশিষ্ট্যের কারণে তাত্পর্যপূর্ণ ভাবে পোস্ট-ট্র্যান্সপ্লান্ট গ্র্যাফ্ট বনাম হোস্ট ডিজিজ কম হারে ঘটে।
  • ‘অটোলোগাস ট্র্যান্সপ্লান্টেশন’ সম্ভব: স্টেম সেলের ক্ষেত্রে ‘অটোলোগাস ট্র্যান্সপ্লান্টেশন’ সম্ভব। অর্থাৎ, বর্তমানে অন্য কোনও চিকিত্সার সুযোগ নেই এমন রোগে একজনের স্টেম সেল তার নিজের চিকিত্সার ক্ষেত্রে ব্যবহার করা যেতে পারে
  • তাত্ক্ষণিক ভাবে পাওয়া যায়: ব্যাঙ্কে রাখা থাকে বলে তাত্ক্ষণিক ভাবে স্টেম সেল পাওয়া যায়। আর তার ফলে গোড়াতেই চিকিত্সা শুরু করে দেওয়া যায়। আক্রান্ত রোগের অগ্রগতি রুদ্ধ করে দ্রুত রোগ সারানো সম্ভব হয়।
  • কঠিন রোগ সারায়: আগেই বলেছি স্টেম সেল চিকিত্সা আসলে রিজেনারেটিভ বা পুনরুজ্জীবনমূলক। তাই স্টেম সেল থেকে রক্তনালি, পেশি, হাড়, কার্টিলেজ এবং স্নায়ু কোষ তৈরি হয়। তার ফলে এরা অনেক কঠিন রোগ সারিয়ে তুলতে সাহায্য করে।
  • বয়স বাড়ে না এবং কার্যকারিতা বজায় থাকে: আগেই জানিয়েছি, সংরক্ষণ করে রাখার জন্য এই সেলগুলির বয়স বাড়ে না। সংরক্ষণের আগে যেমন ছিল, দীর্ঘদিন ধরে সংরক্ষণের পরেও তেমনই থেকে যায়। পরিবেশের বিভিন্ন উপাদান ও সাধারণ ভাইরাসের সংস্পর্শে আসে না বলে এদের কার্যকারিতা সম্পূর্ণ ভাবে বজায় থাকে
  • সরাসরি ব্যবহার যোগ্য: কর্ড ব্লাড স্টেম সেল রেডি-টু-ইউজ অর্থাৎ, সরাসরি ব্যবহার যোগ্য। সংগ্রহের পরে নির্দিষ্ট পরীক্ষা হয়ে গেলে একে ঠান্ডা করে সংরক্ষণ করে রাখা হয়। তার পরে প্রয়োজন পড়লে সরাসরি ব্যবহার করা যেতে পারে। তাতে সময় খরচ কম হয়। রোগী দ্রুত সেরে ওঠে।
  • আংশিক সাদৃশ্যেও ব্যবহারযোগ্য: কর্ড ব্লাডের স্টেম সেলের সঙ্গে রোগীর রক্তের নমুনা সম্পূর্ণ না মিললেও চলে। এটা একটা বিরাট বড় সুবিধে। দাতা ও গ্রহীতার মধ্যে আংশিক সাদৃশ্য থাকলেই কর্ড ব্লাড স্টেম সেল ব্যবহারযোগ্য হতে পারে। তাই ভবিষ্যতে এর ব্যবহার অনেক সহজ।
  • নিরাপদ: বোন ম্যারো প্রতিস্থাপনের তুলনায় কর্ড ব্লাড প্রতিস্থাপন অনেক বেশি নিরাপদ। কারণ, রোগীর দেহের কোষকে আক্রমণ করার (গ্রাফট বনাম হোস্ট ডিজিজ) বিচারে কর্ড ব্লাডের ইমিউন সেলগুলি বোন ম্যারো প্রতিস্থাপনের তুলনায় একেবারেই ঝুঁকিপূর্ণ নয়। এককথায় যথেষ্ট নিরাপদ।
  • সি এম ভি সংক্রমণে নিরাপদ: সাইটোমেগালো ভাইরাস (সি এম ভি)-এর মতো মারাত্মক সংক্রমণ ছড়ানোর ক্ষেত্রেও কর্ড ব্লাড অনেকটাই নিরাপদ। আমেরিকার একটি সংখ্যাতত্ত্ব হল– ওদেশের অর্ধেক প্রাপ্তবয়স্ক সি এম ভি-র কেরিয়ার। তবে এরা সুপ্ত অবস্থাতেই থাকে।

যে যে রোগ সারতে পারে

কর্ড ব্লাড ও কর্ড টিস্যুর যে জীবনদায়ী শক্তি এবং সঞ্জীবনী নিরাময়কারী ক্ষমতা আছে, তা আজ আর কোনও অজ্ঞাত বিষয় নয়। আর এই নিয়ে গবেষণা যত বাড়ছে মানুষ তত আশাবাদী হয়ে উঠছেন। দাবি করা হচ্ছে, কর্ড ব্লাড জীবনের পরিবর্তন, এমন কি জীবনকে রক্ষাও করতে পারে। আসলে এই সেলগুলি অন্যান্য কোষ তৈরিতেও সক্ষম, যার ফলে এরা টিস্যু ও অঙ্গ মেরামতিতে সাহায্য করে। তাই এই সেলগুলিকে অনেকরকম রোগের চিকিত্সায় ব্যবহার করা যায়।

  • ৮০টি রোগ সারায়: দাবি করা হচ্ছে, কর্ড ব্লাডের স্টেম সেল সফলভাবে প্রায় ৮০টি মারাত্মক রকমের জীবনবিপন্নকারী রোগের চিকিত্সায় কাজে লাগতে পারে। এদের মধ্যে অন্যতম হল ক্যান্সার, রক্তের রোগ এবং রোগপ্রতিরোধজনিত অক্ষমতা। এখনও অবধি ৩০,০০০-এরও বেশি স্টেম সেল প্রতিস্থাপন করা হয়ে গেছে।
  • প্রধান প্রধান রোগগুলি: কর্ড ব্লাড যে-সব রোগ সারাতে পারে তার মধ্যে লিউকোমিয়া, অ্যাপ্লিস্টিক অ্যানিমিয়া, থ্যালাসেমিয়া, হজকিনস লিম্ফোমা, নন-হজকিনস লিম্ফোমা এবং নিউরোব্লাস্টোমা অন্যতম। এইসব রোগের কয়েকটির ক্ষেত্রে প্রয়োজনে রোগীকে কেমোথেরাপিও দিতে হয়। সেক্ষেত্রে কেমোথেরাপির পরে স্টেম সেল দিয়ে চিকিত্সার প্রয়োজন।
  • বিপাকীয় সমস্যা: বিপাকীয় বিশৃঙ্খলায় কখনও কখনও কর্ড ব্লাড প্রতিস্থাপন করা হয়। যেমন, গাউচার ডিজিজ, হার্লার সিনড্রোম, ক্রাবে ডিজিজ এবং স্যানফিলিপ্পো সিনড্রোম ইত্যাদি।
  • নতুন আলো: স্টেম সেল চিকিত্সা বহু মানুষের জীবনে নতুন আশার আলো নিয়ে এসেছে। কর্ড ব্লাড থেকে স্কেলেটল ও কার্ডিয়াক পেশি, লিভার ও নিউরন প্রভৃতির টিস্যু তৈরি করা যায়।
  • জিন থেরাপি: এছাড়া স্টেম সেলের সাহায্যে জিন থেরাপিও সম্ভব কারণ, স্টেম সেলের পুনর্গঠনের ক্ষমতা থাকায় নষ্ট হয়ে যাওয়া কোষের জন্য প্রয়োজনীয় জিন সরবরাহ করতে পারে।

আরও যে যে রোগ
সারা পৃথিবী জুড়ে গবেষকেরা এই চেষ্টায় লেগে আছেন যে কিভাবে স্টেম সেল ব্যবহার করে সেরিব্রাল
পলসি, অটিজম, কনজেনিটাল হার্ট ডিফেক্ট, হার্ট ফেলিওর, স্ট্রোক, স্পাইনাল কর্ড ইনজুরি, মাল্টিপল স্ক্লেরেসিস, হিয়ারিং লস, পার্কিনসনস ডিজিজ, টাইপ ১ ডায়াবেটিস এবং অ্যালঝাইমার্স ডিজিজ প্রভৃতি বিরল মারণ রোগের চিকিত্সা করা যায়। এ ছাড়াও ডায়াবেটিস মেলিটাস, রিউম্যাটেড অর্থারাইটিস, ক্রোনস ডিজিজ এবং সিস্টেমিক লুপাস এরিথেমেটোসাস– এই সব রোগের চিকিত্সার চেষ্টাও চলছে।
এমনকী কর্ড ব্লাডকে নতুন অঙ্গ তৈরির কাজেও ব্যবহার করা হচ্ছে।

যেটা গুরুত্বপূর্ণ

আলোচিত রোগগুলির কোনওটার চিকিত্সাতেই স্টেম সেলকে এখনও প্রাথমিক চিকিত্সা হিসেবে গণ্য করা হয় না। বহু বিশেষজ্ঞ পশুদের ওপরে করা গবেষণাগুলির কাগজপত্র দেখিয়ে মানুষের ক্ষেত্রেও একই রকম ভাল ফল পাওয়া যাবে বলে দাবি করতে শুরু করেছেন। এটা সমীচীন নয় এবং প্রতারণার সামিল। আসলে যতদিন পর্যন্ত না মানুষের চিকিত্সায় ভাল ফল পাওয়া যাচ্ছে ততদিন এই ধরনের ঘোষণা না করাই উচিত। অন্যথায় মানুষকে ভুল বোঝানো হবে।

নিচে কয়েকটি রোগ ও শারীরিক বিশৃঙ্খলার তালিকা দেওয়া হল, কর্ড ব্লাড স্টেম সেল দিয়ে এই সব রোগের চিকিত্সা হতে পারে।

ক্যান্সার

  • অ্যাকিউট লিউকেমিয়া
  • ক্রনিক লিউকেমিয়া
  • বোন ম্যারো ক্যান্সার
  • লিম্ফোমা
  • নিউরোব্লাস্টোমা
  • উচ্চ ঝুঁকিসম্পন্ন কঠিন টিউমার
  • হজকিন ও নন-হজকিন লিম্ফোমা
  • মায়েলোডিস্প্ল্যাসটিক সিনড্রোম

বিপাকীয় বিশৃঙ্খলা

  • ক্র্যাব ডিজিজ
  • হার্লার সিনড্রোম
  • মেটাক্রোমাটিক লিউকোডিসট্রফি
  • স্যানফিলিপ্পো সিনড্রোম
  • গাউচার ডিজিজ

রক্তের বিশৃঙ্খলা

  • অ্যাপ্লাস্টিক অ্যানিমিয়া
  • বিটা থ্যালাসেমিয়া
  • ডায়মন্ড-ব্ল্যাকফ্যান অ্যানিমিয়া
  • ফ্যানকোনি অ্যানিমিয়া
  • সিকল্ সেল ডিজিজ

সুরক্ষাগত বিশৃঙ্খলা

  • ক্রনিক গ্র্যানুলোমেটাস ডিজিজ
  • হিস্টোসাইটিক ডিসঅর্ডার
  • লিউকোসাইট অ্যাঢেসন ঘাটতি
  • মারাত্মক কমবাইনড ইমিউনোডেফিসিয়েন্সি ডিজিজ
  • উইসকট-অ্যালড্রিচ সিনড্রোম

সঞ্চয় বা দানের মাধ্যমে প্রাপ্ত স্টেম সেল থেকে তালিকাভুক্ত ওপরের রোগগুলির চিকিত্সা সম্ভব। তবে বংশগত রোগগুলির ক্ষেত্রে শিশুটির নিজস্ব স্টেম সেল ব্যবহৃত হয় না। এক্ষেত্রে প্রাথমিক পছন্দ হল সাদৃশ্যযুক্ত কোনও অন্য সহোদরের স্টেম সেল।

কর্ড ব্লাডের পরম্পরা

১৯৮৫

ডাঃ হ্যাল ব্রক্সমেয়ার সর্বপ্রথম মানুষের কর্ড ব্লাড হেমাটোপোয়েটিক স্টেম এবং প্রোজেনিটর সেল আবিস্কার করলেন।

১৯৮৮

ফ্রান্সের প্যারিসে একটি ছয় বছরের পুরুষ বাচ্চার ক্ষেত্রে প্রথমবারের মতো কর্ড ব্লাড প্রতিস্থাপন করা হল। ছেলেটি ফ্যানকোনি অ্যানিমিয়া নামে এক রক্তের সমস্যায় ভুগছিল।

১৯৯২

নিউ ইয়র্ক ব্লাড সেন্টারে ডাঃ পাবলো রুবেনস্টাইনের উদ্যোগে আমবিলিক্যাল কর্ড ব্লাড সংরক্ষণের জন্য বিশ্বের প্রথম পাবলিক ব্লাড ব্যাঙ্ক প্রতিষ্ঠিত হয়। টাকার বন্দোবস্ত করে আমেরিকার ন্যাশনাল ইনস্টিটিউটের অন্তর্ভুক্ত ন্যাশনাল হার্ট, লাঙ অ্যান্ড ব্লাড ইনস্টিটিউট।

১৯৯৩

ডিউক ইউনিভার্সিটির পেডিয়াট্রিক ব্লাড অ্যান্ড ম্যারো প্রোগ্রামের অধিকর্তা ডাঃ জোয়ান কুর্তজবার্গ বিশ্বের প্রথম সম্পর্কহীন কর্ড ব্লাড
প্রতিস্থাপন করেন।

পুনরুজ্জীবনমূলক ওষুধের প্রয়োগের ক্ষেত্রে আমেরিকার ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (এফ ডি এ) নিয়ন্ত্রিত ক্লিনিক্যাল স্টাডিতে নিচের কয়েকটি সমস্যায় কর্ড ব্লাড স্টেম সেল থেরাপির ব্যবহারের বিষয়ে বিস্তারিত অনুসন্ধান চলছে।

  • অটিজম
  • সেরিব্রাল পলসি
  • পিডিয়াট্রিক স্ট্রোক
  • ট্রমাটিক ব্রেন ইনজুরি
  • অ্যাকওয়ার্ড হিয়ারিং লস
  • ডায়াবেটিস
  • কনজেনিটাল হার্ট ডিফেক্ট
  • হার্চ ফেলিওর
  • স্ট্রোক

এ ছাড়াও এফ ডি এ নিয়ন্ত্রিত সাম্প্রতিক ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে সেই ধরনের স্টেম সেল ব্যবহার করা হচ্ছে যেগুলিকে কর্ড ব্লাড ও কর্ড টিস্যুতে মেলে। তবে গবেষকেরা কিন্তু এখনও নিশ্চিত নন যে, এই সব গবেষণার ফলাফল ঠিক কী হবে। এটা পরিস্কার যে সদ্যোজাতের স্টেম সেল চিকিত্সাবিদ্যার বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা যেতে পারে।

কর্ড ব্লাডের কিছু অসুবিধে

কর্ড ব্লাড স্টেম সেলের সবটাই ভাল, সব কিছুই সমস্যাবিহীন এমন নয়। নিচে কয়েকটি বিষয় জানানো হল যা অসুবিধের।

  • প্রয়োজনের তুলনায় কম স্টেম সেল: সদ্যোজাতের শরীর থেকে সংগৃহীত কর্ড ব্লাডের পরিমাণ খুব একটা বেশি হয় না। তাই এতে স্টেম সেলও যা থাকে তা প্রয়োজনের তুলনায় কম। সুতরাং, শিশু বা কিশোরদের জন্য কার্যকর হলেও প্রাপ্তবয়স্কদের চিকিত্সার ক্ষেত্রে এটি একটি বড় সমস্যা হতে পারে কারণ। এর কারণ, তুলনামূলক ভাবে প্রাপ্তবয়স্কদের শরীরে অনেক বেশি পরিমান স্টেম সেলের প্রয়োজন হয়। সেই কারণে প্রথমবারের নমুনায় যদি কাজ না হয়, তখন অন্য দাতার কাছ থেকে পুনরায় স্টেম সেল সংগ্রহ করতে হয়। সুতরাং, আমরা এমন সিদ্ধান্তে আসতে পারি যে, একজন প্রাপ্তবয়স্কের প্রয়োজনের সময় সংরক্ষিত স্টেম সেল অপর্যাপ্ত হয়ে ওঠার সম্ভাবনাই বেশি
  • সংক্রমণের ঝুঁকি থাকে: কর্ড ব্লাডের স্টেম সেল শরীরে রোপিত হতে বেশ খানিকটা সময় লাগে তাই এদের সংক্রমণের ঝুঁকিও বেশি। যদি এমন হয় তাহলে স্টেম সেল রোপিত নাও হতে পারে। তখন সমস্যা এটাই হয় যে, চাইলেও সেই একই দাতার থেকে আর স্টেম সেল মেলে না
  • সি এম ভাইরাস জনিত সমস্যা: কিছু বিশেষ ক্ষেত্রে স্টেম সেল সাইটোমেগালোভাইরাস (সি এম ভি) নামে ভাইরাসে আক্রান্ত হয় যা গ্রহীতার শরীরে সংক্রমণ সৃষ্টি করে
  • এখনও গবেষণা স্তরে: সর্বোপরি স্টেম সেল এখনও বেশিরভাগ রোগের কাছে উন্মুক্ত হয় নি। অর্থাৎ, এখনও পর্যন্ত ঘোষিত রোগ নিরাময় ক্ষমতার সিংহভাগ আজও গবেষণা স্তরেই রয়ে গেছে

সহোদর/সহোদরাদের ক্ষেত্রে সুবিধে
এটা ঠিক যে কোনও শিশু যদি তার নিজের কর্ড ব্লাড ব্যবহার করে তাহলে ভবিষ্যতে ১০০% সাদৃশ্য
পাওয়া যাবে। যদিও বহু পরিবারের পক্ষে সময় মতো কর্ড ব্লাড সংরক্ষণ করা সম্ভব হয় না। তা ছাড়া
কয়েকটি বংশগত রোগে নিজের স্টেম সেল ব্যবহার করা অসুবিধেজনক। তাই এই ধরনের পরিস্থিতিতে কোনও দাতার (যেমন, সহোদর/সহোদরা) কাছ থেকে কর্ড ব্লাড প্রতিস্থাপন প্রয়োজন হয়ে পড়ে। আত্মীয় সম্পর্কের কারও স্টেম সেল ব্যবহার করার ফলে বহু ক্ষেত্রে বেঁচে ওঠার সম্ভাবনা অনেকটা বেড়ে যায়।
সহোদর/সহোদরা অথবা অন্য পরিবারের সদস্য যাদের মধ্যে এইচ এল এ-র সাদৃশ্য খুব বেশি, তারা
পরস্পরের কর্ড ব্লাড ব্যবহার করে উপকৃত হতে পারেন। এই হিসেবে সহোদর/ সহোদরাদের মধ্যে ২৫%ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ সাদৃশ্য, ৫০% ক্ষেত্রে আংশিক সাদৃশ্য এবং ২৫% ক্ষেত্রে কোনও সাদৃশ্য-ই পাওয়া যায় না। তাই একাধিক সন্তানের কর্ড ব্লাড সংরক্ষণ করলে প্রতিস্থাপনের সময় সাদৃশ্য যুক্ত রক্ত পাওয়ার সম্ভাবনা বেশি।

কর্ড ব্লাড ব্যাঙ্ক

সদ্যোজাতের আম্বিলিক্যাল কর্ড ও প্ল্যাসেন্টা থেকে সংগৃহীত কর্ড ব্লাড ভবিষ্যত চিকিত্সার প্রয়োজনে যেখানে সংরক্ষণ করে রাখা হয় তাকেই কর্ড ব্লাড ব্যাঙ্ক বলে। আমরা আগেই জানিয়েছি, এই রক্তের নমুনাতে থাকা কোষ (স্টেম সেল) থেকে ভবিষ্যতে অনেক কঠিন রোগের চিকিত্সা সম্ভব।

ব্যাঙ্কের রকমফের: বর্তমানে আপনার শিশুর কর্ড ব্লাড দুই ধরনের ব্যাঙ্কে সংরক্ষণ করে রাখা যেতে পারে।

পাবলিক ব্যাংক: পাবলিক ব্যাঙ্ক স্বেচ্ছায় দেওয়া কর্ড ব্লাড বিনামূল্যে সংরক্ষণ করে রাখে। তার ফলে এটি ভবিষ্যতে যে-কোনও মানুষের শরীরে প্রতিস্থাপনের জন্য ব্যবহার করা যেতে পারে। এই পদ্ধতি রোগীদের পক্ষে খুবই উপকারী এবং বহু রোগগ্রস্ত মানুষের চিকিত্সার কাজে আসতে পারে। এ ছাড়া এটিকে গবেষণার প্রয়োজনেও কাজে লাগানো যেতে পারে।

পাবলিক ব্যাঙ্কে কর্ড ব্লাড রাখা যেহেতু এক ধরণের দান, তাই কোনও বাবা-মা যখন তাঁদের সন্তানের কর্ড ব্লাড পাবলিক ব্যাঙ্কে সংরক্ষণ করতে চান তখন তাঁদের এই মর্মে বিবৃতি দিতে হয় যে, তাঁরা রক্তের ওপর থেকে সত্ব ত্যাগ করলেন এবং সংরক্ষিত রক্ত ভবিষ্যতে ব্লাড ব্যাঙ্কের নিজস্ব সম্পত্তি বলে বিবেচিত হবে। এর অর্থ, সরকার বিনামূল্যে আপনার শিশুর কর্ড ব্লাড সংরক্ষণ করবে। যে কারও প্রয়োজন হলে সেটা ব্যবহার করা হবে এবং প্রয়োজনে আপনার শিশুর জন্য সেটি নাও পাওয়া যেতে পারে। সুতরাং, পরবর্তী কালে এই রক্ত যে ওই নির্দিষ্ট দাতা শিশু বা তার পরিবারের জন্য পাওয়া যাবেই তার কোনও গ্যারান্টি থাকছে না।

প্রাইভেট ব্যাঙ্ক: প্রাইভেট ব্যাংক অর্থের বিনিময়ে কর্ড ব্লাড সংরক্ষণ করে। তবে এই ভাবে সংরক্ষিত কর্ড ব্লাড কিন্তু আম-জনতার ব্যবহারের জন্য নয়। এটি শুধুমাত্র দাতা বা তার পরিবারের কোনও সদস্যদের (যেমন, বাবা-মা কিংবা ভাই) প্রয়োজনে ব্যবহার করা যেতে পারে। যেহেতু নির্দিষ্ট পরিবারটি এই কর্ড ব্লাডের মালিক তাই এটাকে কীভাবে ব্যবহার করা হবে সেই সিদ্ধান্ত তাঁরাই নিতে পারবেন।

প্রাইভেট ব্লাড ব্যাঙ্ক যেভাবে সংগ্রহ করবে

আপনার সন্তানের জন্য প্রাইভেট ব্লাড ব্যাঙ্ক নির্ধারিত হয়ে গেলে সেই ব্যাঙ্কই আপনাকে কালেকশন কিট পাঠিয়ে দেবে। সন্তান প্রসবের ব্যবস্থা হয়ে আছে যে হাসপাতালে, সেখানে প্রসবের আগে সেই কিটটিকে পৌঁছে দিতে হবে। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ সেই রক্ত সংগ্রহ করে দিলে আপনার দায়িত্ব হবে সেটিকে নির্দিষ্ট ব্যাঙ্কে পৌঁছে দেওয়া।

নিয়ন্ত্রণ

আমেরিকার চিকিত্সা নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (এফ ডি এ) সমস্ত ধরনের কর্ড ব্লাড ব্যাঙ্কগুলিকে ‘হিউম্যান সেলস, টিস্যুস অ্যান্ড সেলুলার অ্যান্ড টিস্যু বেসড প্রোডাক্ট’-এর আয়ত্ত্বাধীন বিষয় হিসেবে গন্য করে ও সেই অনুযায়ী নিয়ন্ত্রণ করে। অন্য দেশেও কর্ড ব্লাড ব্যাঙ্ক-এর ক্ষেত্রে সরকারী নিয়ন্ত্রণ আছে। যেমন, ইউনাইটেড কিংডম-এ এই বিষয়টি দেখাশোনা করে হিউম্যান টিস্যু অথরিটি। আমাদের দেশে ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অফ মেডিক্যাল রিসার্চ (আই সি এম আর) এবং ডিপার্টমেন্ট অফ বায়োটেকনোলজি যৌথভাবে ‘ন্যাশনাল গাইডলাইনস ফর স্টেম সেল রিসার্চ’ নিয়ে তাদের সুচিন্তিত বক্তব্য প্রকাশ করেছে। এ দেশে তারাই এই কর্ড ব্লাড স্টেম সেল চর্চার অভিভাবক।

আমাদের দেশে যা বলা হচ্ছে

২০১৩ সালের ডিসেম্বর মাসে ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অফ মেডিক্যাল রিসার্চ (আই সি এম আর) এবং ডিপার্টমেন্ট অফ বায়োটেকনোলজি প্রকাশিত ‘ন্যাশনাল গাইডলাইনস ফর স্টেম সেল রিসার্চ’-এর ভূমিকায় জানানো হয়েছে – ‘… স্টেম সেল গবেষণার ক্ষেত্রটি এখনও কৈশোরে। মাত্র এক দশক আগে হিউম্যান এমব্রায়োনিক স্টেম সেলের সফল পরিশীলন এবং চরিত্রচিত্রণ সম্ভব হয়েছে। তার পর থেকে স্টেম সেলের মৌলিক জীবতত্ত্ব এবং তাদের বিভিন্ন কোষঘটিত চারিত্রিক বৈশিষ্টের পার্থক্য নিয়ে যে কিছুটা উন্নতি হয়েছে তা ঠিক, তবে পুনরুত্পাদনশীল বা রিজেনারেটিভ চিকিত্সার ক্ষেত্রে তাদের প্রতিশ্রুত ক্ষমতা প্রদানকারী যুগে প্রবেশ করার জন্য এখনও অনেক পথ হাঁটতে হবে। .. এখনও পর্যন্ত কোনও ক্ষেত্রেই স্টেম সেলের চিকিত্সাবিদ্যাগত কার্যক্ষমতার সুরক্ষিত ও নির্দিষ্ট প্রমাণ মেলেনি। দুর্ভাগ্যবশত, কিছু ক্লিনিক দুর্ভাগা রোগীদের অসমর্থিত স্টেম সেল চিকিত্সার পরিষেবা প্রদানের কথা বলে প্রতারণা করছে। এই ধরনের প্রতারণা জরুরি ভিত্তিতে বন্ধ করা উচিত ..।’

কমিটির একটি গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশ ছিল নির্দেশিকার শিরোনাম থেকে ‘থেরাপি’ শব্দটাকে বাদ দেওয়া। স্টেম সেল যে এখনও চিকিত্সা পরিষেবার নির্দিষ্ট মানদণ্ডের অংশ হয়ে ওঠেনি সেটাকে গুরুত্ব দেওয়াই ছিল এই সুপারিশ প্রস্তুতির সবচেয়ে বড় কারণ। সুতরাং, চিকিত্সার কার্যকারিতা নিশ্চিত ভাবে প্রমাণিত না হলে কোনও নির্দেশিকা থাকতে পারে না।

যুক্তিগ্রাহ্যতা

কর্ড ব্লাড ব্যাঙ্কিং আজ একটি চূড়ান্ত আলোচিত বিষয়। গোটা বিশ্ব জুড়েই প্রচুর সংখ্যক প্রাইভেট কর্ড ব্লাড ব্যাঙ্ক স্থাপিত হয়েছে। ব্যাঙ্কগুলি বিখ্যাত সব ব্যক্তিত্ব, অভিনেতা ও অভিনেত্রীদের মডেল হিসেবে ব্যবহার করে সংবাদপত্র-সহ নানা প্রেগন্যান্সি বিষয়ক পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিচ্ছে। বিজ্ঞাপনের বিষয়বস্তু হিসেবে বলা হচ্ছে যে, সন্তানের শারীরিক ভবিষ্যত সুরক্ষিত করতে কর্ড ব্লাড সংরক্ষণ একটি অমূল্য সুযোগ। ব্যাঙ্কগুলি এই সংরক্ষণকে একটি ‘সেল্ফ রিপেয়ার কিট’ হিসেবে তুলে ধরছে। একজন অভিভাবক কিংবা বাবা-মায়ের কাছে শিশুর ভবিষ্যতের তুলনায় কোনও খরচই যে বড় নয় এটা ঠিক, তবুও যেহেতু এটা প্রমাণিত নয় যে অন্যান্য কম খরচের চিকিত্সার চেয়ে কর্ড ব্লাডের সাহায্যে চিকিত্সা বেশি লাভজনক, তাই বিপুল এই খরচের যুক্তিগ্রাহ্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠে আসে। দেখা যাক, এই প্রসঙ্গে কি কি বলা হচ্ছে?

  • পয়সা খরচ করে বিজ্ঞাপন কেন?: সত্যিই যদি প্রাইভেট সংস্থাগুলিতে কর্ড ব্লাড সংরক্ষণে এতটাই সুবিধে থাকে তাহলে তো মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবেই এখানে আসবেন। চিকিত্সকরাও সেরকম পরামর্শই দেবেন। খ্যাতনামা ব্যক্তিদের দিয়ে অত অত পয়সা খরচা করে বিজ্ঞাপন করানোর প্রয়োজনটা ঠিক কোথায়? সন্দেহ দানা বাঁধে এখানেই।
  • বাস্তবের বদলে ভবিষ্যতের কথা: প্রাইভেট কর্ড ব্লাড ব্যাঙ্কগুলি থেকে যে প্রচারপত্র বিলি করা হয় তাতে বর্তমানের বদলে ভবিষ্যতের কথা বেশি করে বলা হয়ে থাকে। এ যেন বাস্তব ছেড়ে অনির্দেশে পা বাড়ানো।
  • এখনও গবেষণাস্তরে: এমনও একটা দাবী করা হয় যে, কর্ড ব্লাড রক্তের কনিকা নতুন করে তৈরি করতে বা মেরামত করতে পারে। এ ছাড়া এরা নাকি নতুন টিস্যু বা অঙ্গ তৈরি করতেও সক্ষম। কিন্তু যেটা বলার তা হল, এই সমস্ত বিষয়গুলি যে হয় না, তা যেমন বলা যায় না, একইভাবে হয়, তাও নিশ্চিত করে বলা যায় না। আদতে গোটা বিষয়টিই এখনও গবেষণাস্তরে আছে। তাই এর পিছনে বৈজ্ঞানিক যুক্তি থাকলেও আদপে বর্তমান চিকিত্সা ব্যবস্থায় তার ব্যবহারের সুযোগ খুবই সীমিত। সুতরাং, যা বলা হচ্ছে ঠিক তেমনটাই যে হবে তার কোনও নিশ্চয়তা নেই।
  • ব্যবহারের সম্ভাবনা ক্ষীণ: আমেরিকান অ্যাকাডেমি অফ পিডিয়াট্রিকস (এ এ পি) জানাচ্ছে, ভবিষ্যতে কোনও শিশুর জমিয়ে রাখা কর্ড ব্লাড ব্যবহারের সম্ভাবনা ১ : ১,০০০ থেকে ১ : ২,০০,০০০। অর্থাৎ, ১,০০০ জন শিশুর মধ্যে ১ জন থেকে ২,০০,০০০ জন শিশুর মধ্যে ১ জনের ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে কর্ড ব্লাড ব্যবহারের সম্ভাবনা আছে।
  • কোনটা বেশি উপকারী: এ এ পি এমনও জানাচ্ছে যে, ম্যাচিং ডোনারের স্টেম সেলের চেয়ে ব্যক্তিবিশেষের নিজের স্টেম সেল বেশি উপকারী এমন কোনও প্রমাণ এখনও পর্যন্ত পাওয়া যায় নি।
  • পাবলিক ব্যাঙ্ক থেকে স্টেম সেল নেওয়াই ভাল: ব্যাঙ্কগুলি থেকে বিজ্ঞাপন দিয়ে জানানো হচ্ছে, যেহেতু প্রত্যেকের ক্ষেত্রে স্টেম সেল জেনেটিক্যালি আলাদা, তাই সবার উচিত একে ব্যক্তিগত স্তরে সংরক্ষণ করা। অথচ গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে যে কর্ড ব্লাড স্টেম সেলের ক্ষেত্রে বোন ম্যারোর মতো দাতা ও গ্রহীতার মধ্যে অত সুক্ষ সাদৃশ্যের দরকার নেই। আর তাই পাবলিক কর্ড ব্লাড ব্যাঙ্ক থেকে অনেক সহজে স্টেম সেল নেওয়াটাই বুদ্ধিমানের। তাছাড়া প্রয়োজন হলে একাধিক দাতার থেকেও তা নেওয়া যেতে পারে।
  • সংরক্ষিত কর্ড ব্লাড ব্যবহৃত হয়েছে খুব কম: জানা গেছে, নিজের জন্য সংরক্ষিত কর্ড ব্লাডের নমুনা দিয়ে চিকিত্সা হচ্ছে এমন রোগীর সংখ্যা নিতান্তই কম। সংখ্যাতত্ত্বের বিচারে সেটি হল ২,৭০০ থেকে ২,০০,০০ জনের মধ্যে মাত্র ১ জনের।
  • স্টেম সেল সবসময় ব্যবহারযোগ্য নয়: বেশ কিছু রোগে স্টেম সেল ব্যবহার করা যায় না। যেমন, ক্যান্সারের ক্ষেত্রে নিজস্ব স্টেম সেল দিয়ে চিকিত্সা করা যায় না কারণ সেক্ষেত্রে স্টেম সেলেও ক্যান্সারের কোষ থাকার ঝুঁকি থেকে যায়।
  • প্রয়োজনের তুলনায় স্টেম সেল কম থাকে: বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই প্রাপ্তবয়স্কদের চিকিত্সার জন্য মজুত নমুনার পরিমান চিকিত্সার প্রয়োজনের তুলনায় পর্যাপ্ত হয় না কারণ, প্রতিটি কর্ডে খুব বেশী স্টেম সেল থাকে না। বোন ম্যারো অথবা পেরিফেরাল ব্লাড এর সঙ্গে তুলনা করলে অনেক সুযোগ থাকে, কিন্তু রক্ত এবং বোন ম্যারো তৈরি করতে যে স্টেম সেল আসলে স্থাপন করা দরকার সেটা করতে পারে না। গোটা বিষয়টিকে অনেক বড় একটা বাগানে অল্প বীজ ছড়ানোর মতো বলে ব্যাখ্যা করা যেতে পারে। কখনও কখনও যা কাজে আসে না।
  • বংশগত রোগে চিকিত্সা চলে না: বিশেষ কিছু ক্ষেত্র যেমন, ইনহেরিটেড হেমাটোলজিক, ইমিউনোলজিক, জেনেটিক ডিসঅর্ডার বা ম্যালিগন্যান্সিতে নিজের স্টেম সেল দিয়ে চিকিত্সা করা সম্ভব হয় না। কারণ এতে আবার সেই রোগ হওয়ার ঝুঁকি থেকে যায়। এক্ষেত্রে আত্মীয়দের বোন ম্যারো ভালো বিকল্প হলেও নিজের স্টেম সেল ব্যবহার যোগ্য নয়।
  • আমেরিকান অ্যাকাডেমি অফ পিডিয়াট্রিকস–এর ঘোষণা: আমেরিকান অ্যাকাডেমি অফ পিডিয়াট্রিকস এক কদম এগিয়ে স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দিয়েছে যে, এখনও তেমন কোনও গবেষণা নেই যাতে প্রমাণ করা যায় যে দাতার স্টেম সেল থেকে নিজস্ব স্টেম সেল ব্যবহার করা বেশি লাভজনক। তাদের মতে– ‘বায়োলজিক্যাল ইনস্যুরেন্স’ হিসেবে কর্ড ব্লাডের প্রাইভেট মজুত ততক্ষণ পর্যন্ত অবিবেচনাপ্রসূত কাজ, যতক্ষণ পর্যন্ত না কোনও পারিবারিক সদস্যের স্টেম সেল ট্র্যান্সপ্ল্যান্টেশন–এর সাম্প্রতিক প্রয়োজনীয়তা কিংবা বাস্তবিক চাহিদা থাকে।’
  • পাবলিক ব্লাড ব্যাঙ্ক থেকেও চিকিত্সা হতে পারে: আপনি যদি ঠিক করেন যে সন্তানের কর্ড ব্লাড আদৌ সংরক্ষণ করবেন না, তাহলে পরবর্তীকালে কোনও রোগ হলেও এমন ভাববেন না যে আপনি ভুল করে ফেলেছেন। মনে রাখবেন, ম্যাচিং ডোনারের শরীর থেকে বোন ম্যারো প্রতিস্থাপন এখনও একটি বিকল্প। তাছাড়া পাবলিক কর্ড ব্লাড ব্যাংক থেকে ম্যাচিং কর্ড ব্লাডও পাওয়া যেতে পারে। আর তাই এখনও অবধি পাবলিক কর্ড ব্লাড ব্যাঙ্কের সঙ্গে ডাক্তারি মহলের সেই অর্থে কোনও বিরোধিতা নেই।
  • বুঝে সিদ্ধান্ত নিন: এই বিষয়গুলি ভাল করে বুঝুন। আর তা হলেই ভয় বা ভবিষ্যতের কথা ভেবে আপনাকে ভিত্তিহীন সিদ্ধান্ত নিতে হবে না।

হয়রানির একটি উদাহরণ

আমেরিকার নিউ ইয়র্ক-স্থিত লং আইল্যান্ডের দম্পতি ট্রেসি ও ভিক্টর ডোনেস বেশ কিছুদিন আগে একটি প্রাইভেট কর্ড ব্লাড ব্যাঙ্কের বিরুদ্ধে মিথ্যে বিজ্ঞাপন এবং উপভোক্তাদের প্রতারণা করার জন্য মামলা করেন। আদালত তাঁদের পক্ষেই রায় দেয়।

যা হয়েছিল: সন্তান জন্মের পরিকল্পনা চলাকালীন ওই নির্দিষ্ট ব্যাঙ্কের বিজ্ঞাপন দেখে তাঁরা সেখানে বাচ্চাটির কর্ড ব্লাড সংরক্ষণ করবেন এমন স্থির করেন। নিয়মমাফিক টাকা জমা ও অন্যান্য কাজকর্ম করে তাঁরা নির্দিষ্ট সময়ে কর্ড ব্লাড জমাও রাখেন। এই পর্যন্ত সব ঠিক ছিল। তবে সমস্যার সূত্রপাত হয় বাচ্চার ৪ মাস বয়স হলে। ওই সময় বাচ্চাটির অস্টিওপোরেসিস রোগ ধরা পড়ে। এটি এমন একটি মারাত্মক রোগ যাতে হাড় গঠনের ক্ষেত্রে সমস্যা হয়। রোগটি দুরারোগ্যও বটে।

যা জানলেন: ভীত ট্রেসি ও ভিক্টর চিকিত্সকের পরামর্শ নিতে গিয়ে জানতে পারেন রোগ সারানোর একটি মাত্র উপায়ই আছে। যদি বাচ্চাটির শরীরে স্টেম সেল প্রতিস্থাপন করা যায় তাহলে বাচ্চাটি সেরে উঠতে পারে। যেহেতু ডোনেস দম্পতির সন্তানের কর্ড ব্লাড প্রাইভেট ব্যাঙ্কে রাখা ছিল তাই তাঁরা নিশ্চিন্ত চিত্তে সেই ব্যাঙ্ক থেকে রক্ত সংগ্রহ করতে গেলেন। তবে তাঁদের জন্য সেখানে হতাশা আর বিস্ময় অপেক্ষা করে ছিল। ব্যাঙ্কে গিয়ে তাঁরা জানতে পারলেন, তাঁদের বাচ্চার স্টেম সেল তার নিজের শরীরে ব্যবহার যোগ্য নয় কারণ, ওই সেলগুলিতে সেই বংশগত বিশৃঙ্খলা আছে যা থেকে বাচ্চাটির অস্টিওপোরেসিস হয়েছে। আশ্চর্যের বিষয় হল ব্যাংকের দেওয়া বিজ্ঞাপনে কিন্তু এই ধরনের ঝুঁকির কোনও উল্লেখ ছিল না। সেখানে যা লেখা ছিল তা সবই ভাল ভাল কথা।

যা হচ্ছে: এটা সত্যি যে, গবেষণার মাধ্যমে এই চিকিত্সা সম্পর্কে অনেক যুগান্তকারী আবিষ্কার করা গেছে কিন্তু প্রাইভেট ব্যাঙ্কগুলি এটা নিয়ে একটু বেশি আশার কথাই শুনিয়ে ফেলে। যার কোনও সঠিক তথ্য এখনও পাওয়া যায় নি সেটাকেও ইতিবাচক ইঙ্গিত দিয়ে বিজ্ঞাপন দিয়ে দেয়। তাতে ডোনেস দম্পতির মতো অনেকেই বিভ্রান্ত হন। তাছাড়া অনেক কথা গোপনও রাখে, যা স্বচ্ছ ব্যবসার পরিপন্থী।

সতর্ক করেছে যারা

তবে শুধু ডোনেস দম্পতি নয়, নিজেদের ব্যবসায়ীক স্বার্থের খাতিরে প্রাইভেট কর্ড ব্লাডের নানা ধরনের ভিত্তিহীন দাবী নিয়ে মুখ খুলেছে আমেরিকান কলেজ অফ অবস্ট্রেটেশিয়ানস অ্যান্ড গাইনকলোজিস্ট (এ সি ও জি) এবং আমেরিকা অ্যাকাডেমি অফ পেডিয়াট্রিকস (এ এ পি)-ও। ১৯৯০ সালেই রীতিমতো বিবৃতি প্রকাশ করে এই ধরনের লাভজনক ব্যাঙ্কের বাজারি কৌশলের বিরুদ্ধে আক্রমণ শানিয়েছে এই দুই সংস্থা।

পরামর্শ: তারা সাধারণ মানুষদের এই পরামর্শ দিয়েছে যে, যদি কেউ সন্তানের কর্ড ব্লাড সংরক্ষণ করতেই চান তাহলে তা যেন পাবলিক কর্ড ব্লাড ব্যাঙ্কে রাখেন। সেক্ষেত্রে বিনামূল্যে রাখা এই কর্ড ব্লাড অন্য যে-কারও উপকারে আসতে পারে। বানিজ্যিক ভাবে কর্ড ব্লাড সংরক্ষণ করাটা যে বৈধ নয় তা স্বীকার করে নিয়েছে বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক সংগঠনও।

নিষিদ্ধ অনেক দেশেই: গোটা বিশ্বের নিরিখে অন্য অনেক দেশের বহু সংস্থাও এই নিয়ে সরব হয়েছে। এই ধরনের ব্যাঙ্ক যে বিশেষ পরিষেবা বিক্রি করছে তা সত্যিই ভবিষ্যতে কতটা কার্যকরী, তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে। ইতালি ও ফ্রান্সে তো প্রাইভেট কর্ড ব্লাড ব্যাঙ্ক পুরোপুরি নিষিদ্ধ। এ ছাড়া ইউরোপের কয়েকটি দেশেও প্রাইভেট ব্যাঙ্কে কর্ড ব্লাডের সংরক্ষণকে নিরুত্সাহ করা হয়।

আমাদের দেশে

সারা পৃথিবীর ১৪২টি পাবলিক কর্ড ব্লাড ব্যাঙ্কের মাত্র ৩টি আছে আমাদের দেশে। অথচ সমগ্র বিশ্বের ২৫টি প্রাইভেট কর্ড ব্লাড ব্যাঙ্কের মধ্যে ৭টি শুধু ভারতবর্ষে গজিয়ে উঠেছে। এ থেকেই বোঝা যাচ্ছে ব্যবসায়ী মহল এই ধরনের প্রাইভেট ব্যাঙ্ক স্থাপনে কতটা আগ্রহী। বিশ্বের বহু মানুষ পাবলিক ব্যাঙ্কে কর্ড ব্লাড সংরক্ষণ করতে চান, তবে বিজ্ঞাপনের কল্যাণে এবং কিছু অসাধু চিকিত্সকের দোষে বর্তমানে প্রাইভেট ব্যাঙ্কেরই রমরমা বেশি।

শেষে

আজকাল বিভিন্ন বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে ভবিষ্যতের অভিভাবকদেরকে কর্ড ব্লাড সংরক্ষণের ব্যাপারে উত্সাহিত করা হচ্ছে। তবে ওপরের আলোচনা থেকে এটা নিশ্চয়ই পরিস্কার করতে পেরেছি যে, কর্ড ব্লাড সংরক্ষণ কিছু কিছু পরিবারের পক্ষে হয়ত জীবনদায়ী, তবে সবার ক্ষেত্রে চিকিত্সার ব্যাপারে বিশেষ সুবিধে প্রদান করবে এমন নয়। অনেককে এমন বলতে শুনি যে, গবেষণা যখন চলছে তখন এমন দিন আসতেই পারে যখন কর্ড ব্লাডের প্রয়োজনীয়তা অপরিহার্য হয়ে উঠবে। তখন তো আর মাথা খুড়লেও কর্ড ব্লাড পাওয়া যাবে না। কারণ, জন্মমুহূর্তে সংগ্রহ করতে না পারলে এই রক্ত তো নষ্ট হয়ে যায়। কথাটা যে অযৌক্তিক, তা কিন্তু নয়। তবে প্রশ্ন হল, যেটা আজও একটা সম্ভাবনা, সেই অজ্ঞাত ভবিষ্যতের জন্য আজ থেকে এত খরচ করাটা কতটা যুক্তিযুক্ত? আজকের দিনে সন্তান পালন করাটাই যেখানেই বেশ ব্যয়বহুল, সেখানে বিপুল প্রাথমিক খরচের পরেও নিয়মিত ভাবে মাসে মাসে প্রাইভেট কর্ড ব্লাড ব্যাঙ্কের সংরক্ষণ বাবদ অর্থ খরচ করাটা কি নিরর্থক নয়!

বরং

বরং সদ্যোজাত সন্তানের কর্ড ব্লাড বিনা পয়সায় পাবলিক ব্লাড ব্যাঙ্কে সংরক্ষণ করাটা একটি মহৎ কাজ হতে পারে। এর ফলে সত্যিই যাদের স্টেম সেল প্রয়োজন তাঁরা এই সুবিধে নিতে পারেন। তাই পাবলিক ব্লাড ব্যাঙ্কে কর্ড ব্লাড রাখলে সামাজিক দায়বদ্ধতারও প্রকাশ ঘটে। প্রাইভেট ব্লাড ব্যাঙ্কের ক্ষেত্রে সবচেয়ে সমালোচনার বিষয়টি হল প্রাইভেট ব্যাঙ্কগুলিতে যে শিশুটির কর্ড ব্লাড রাখা হল সেটি যদি তার কাজেও না লাগে তাহলেও সেটি তার পরিবার ছাড়া অন্য কারও কাজে ব্যবহার করা যাবে না।

পর্বতের মূষিক প্রসব

আগেই বলেছি, বিভিন্ন দেশের সরকার ও বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন প্রাইভেট ব্যাঙ্কগুলির অসাধু ব্যবসার বিরুদ্ধে সরব হয়েছে। আমেরিকান অ্যাকাডেমি অফ পিডিয়াট্রিকস (এ এ পি) ও আমেরিকান সোসাইটি ফর ব্লাড অ্যান্ড ম্যারো ট্র্যান্সপ্লান্টেশন ( এ এস বি এম টি)-এর মত হল সবারই উচিত সরকারি অর্থাৎ, পাবলিক ব্যাঙ্কে বিনা খরচায় ব্লাড জমা করা। কেবলমাত্র যে সমস্ত পরিবারে এমন কিছু অসুখ হয়েছে যার চিকিত্সা স্টেম সেলের সাহায্যে সম্ভব, তাঁদেরই বংশে কারও সন্তান হলে সেই শিশুর কর্ড ব্লাড সম্ভব হলে অর্থের বিনিময়ে প্রাইভেট ব্যাঙ্কে সংরক্ষণ করা যুক্তিযুক্ত। কারণ এই স্টেম সেল দিয়ে পরিবারের মধ্যেকার কোনও অসুস্থ রোগীর চিকিত্সায় সহায়তা মিলতে পারে।

সুতরাং, নির্দিষ্ট তথ্যের ভিত্তিতে এমন সিদ্ধান্ত নিন যা মানসিক, শারীরিক ও অর্থনৈতিক ভাবে আপনাকে সন্তুষ্ট রাখবে। আমেরিকান কলেজ অফ অবস্ট্রেটেশিয়ানস অ্যান্ড গাইনকলোজিস্ট (এ সি ও জি) এই বিষয়ে জোর দিচ্ছে যে, গর্ভবতী মহিলারা চিকিত্সাধীন ডাক্তারদের কাছ থেকে পাবলিক ব্যাঙ্ক ও প্রাইভেট ব্যাঙ্কে কর্ড ব্লাড সংরক্ষণের সুবিধে ও অসুবিধে নিয়ে বিস্তারিত ভাবে জেনে নিক। বেশিরভাগ চিকিত্সাবিদরা প্রাইভেট কর্ড ব্লাড ব্যাঙ্কিং-কে গুরুত্ব দিতে নারাজ কারণ, ব্যবহারের সম্ভাবনা বিবেচনা করলে খরচের নিরিখে তা পর্বতের মূষিক প্রসবের সমান।

এ ছাড়াও আমার মনে হয়, সমস্ত ধাত্রীবিশেষজ্ঞদেরও অনেক বেশি তত্পর হয়ে হবু বাবা-মায়েদের প্রাইভেট কর্ড ব্লাড ব্যাঙ্কগুলির দাবীর যৌক্তিকতা এবং ভবিষ্যৎ ব্যবহার সম্পর্কে বিস্তারিত ভাবে বোঝানো প্রয়োজন। তাঁদের মধ্যে এই ব্যাপারে একটা সচেতনতা তৈরি করে দেওয়াটা প্রয়োজন। কারণ, শিশুদের মধ্যেই তো আমাদের বেঁচে থাকা। শিশুরা সুস্থ থাকুক সব দেশে, সবসময়। তবে অবশ্যই অসাধু ব্যবসায়ীদের খপ্পরে পড়ে নয়।

কৃতজ্ঞতা- বিশিষ্ট ধাত্রীবিশেষজ্ঞ ডাঃ গৌতম খাস্তগীর

কিছু কথা: উপরের আটির্কেলটি সহজপাঠ্য, আকর্ষণীয় ও সহজবোধ্য করার জন্য পরিমাজির্ত সংস্করণে প্রয়োজনীয় সংযোজন, পরিবর্ধন, পুনলির্খন ও সম্পাদনা করেছে সমগ্র বাংলা টিম। বর্তমান বিশ্বায়নের যুগে আমাদের কারোই ঘরে বসে থাকার সুযোগ নেই অথবা কেউই একা পথ চলার ফুরসত নেই। তাই আমাদের চিন্তা, চেতনা ও বুদ্ধির বিকাশকে কাজে লাগিয়ে মানুষের কল্যাণের জন্য নতুন কিছু সৃষ্টি করতে পারলে তবেই আমরা জাতি হিসাবে টিকে যাবো। উপকৃত হবে সমাজ জাতি এবং আগামী প্রজন্ম। এরই লক্ষ্যে মূলত একটা অলাভজনক, অরাজনৈতিক সামাজিক ও শিক্ষা মূলক সমগ্র বাংলা ওয়েব সাইট । এই ওয়েব সাইটি কয়েকজন যুবকের দ্বারা নিয়ন্ত্রন ও এর কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। বিভিন্ন সামাজিক কর্মকান্ডের মাধ্যমে এর পরিধি আরও বধির্ত হবে। এছাড়া সম্মানীত পাঠক গন, আমাদের সকল কার্যক্রম সম্পর্কে আপনাদেরকে নিয়মিত জানানোর জন্য আমরা খুব শীঘ্রই নিউজলেটার তৈরী করতে যাচ্ছি। নিবন্ধন করে আমাদের সাথেই থাকবেন। ধন্যবাদ

তথ্যটি গুরুত্বপূর্ণ মনে হলে শেয়ার করুন

More News Of This Category