June 8, 2023, 10:43 am
বিবর্তনের শুরু থেকে পৃথিবী জুড়ে সূর্য ও চন্দ্রগ্রহণ নিয়ে রয়েছে হাজারো জনশ্রুতি, কল্পকাহিনি ও কুসংস্কার। সূর্য বা চন্দ্রগ্রহণকে ঘিরে বাংলাদেশ সহ পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে নানারকম ‘ধারণা’ চালু রয়েছে। মহাজাগতিক এ সূর্য গ্রহণ নিয়ে প্রচলিত ধারণাকে ঘিরে যুগ যুগ ধরে নানা কথা রটেছে। তবে এখনকার বিজ্ঞান অনেক কুসংস্কার ভেঙেছে।
রান্না করা, খাবার খাওয়া: এরকম একটি কুসংস্কার প্রচলিত রয়েছে যে, সূর্যগ্রহণের সময় কোনো ধরণের খাবার বা পানীয় গ্রহণ করলে তা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর।অনেক জায়গায় এরকমও ধারণা রয়েছে যে সূর্যগ্রহণের সময় রান্না করা হলে সেটিও অমঙ্গলজনক। কিন্তু এরকম ধারণার কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি বিজ্ঞানীরা কখনোই পাননি।
রান্না ও খাওয়া উচিত নয়: প্রচলিত বিশ্বাস অনুযায়ী সূর্যগ্রহণের সময় রান্না ও খাওয়া উচিত নয়। এই সময় সূর্যের আলো পৃথিবীতে এসে না পৌঁছনোয় পৃথিবীতে রেডিয়েশনের মাত্রা অনেকটা বেড়ে যায়।
গর্ভবতী নারীদের বাইরে বের হওয়া: প্রচলিত ধারণা অনুযায়ী, সূর্যগ্রহণের সময় গর্ভবতী নারীরা ঘরের বাইরে বের হলে গর্ভের সন্তানের শরীরে বিশেষ ধরণের জন্মদাগ থাকতে পারে। এমনকি সন্তানের হৃৎপিণ্ডে ছিদ্র থাকা বা বিকলঙ্গতা নিয়েও সন্তান জন্ম নিতে পারে। তাই, ‘সংস্কার’ আছে, সূর্যগ্রহণের সময়ে গর্ভবতী নারীদের ঘরের বাইরে যাওয়া ঠিক হবে না। এই ধারণাও বৈজ্ঞানিকভাবে ভিত্তিহীন হিসেবে প্রমাণিত হয়েছে অনেক আগেই।
গর্ভবতী নারীদের কিছু কাটাকাটি: গর্ভাবস্থায় কোনো নারী সূর্য অথবা চন্দ্রগ্রহণের সময় যদি কিছু কাটাকাটি করেন তাহলে গর্ভের সন্তানের নাকি অঙ্গহানি হয়। আসলে এগুলোর সবই এক শ ভাগ কুসংস্কার।
প্রসূতি মায়েদের ভয়: সূর্যগ্রহণের সময় জন্ম নেওয়া শিশুদের ব্যাপারে দুই ধরনের গপ্প শুনতে পাওয়া যায়। এক, শিশুটি অসুস্থ হবে এবং দুই, শিশুটি চালাক হবে। তবে এ দুটি ধারণার কোনোটার ক্ষেত্রেই বিশ্বাস করার মতো যুক্তি বা তথ্য পাওয়া যায় না। প্রাচীন অ্যাজটেক সভ্যতায় বিশ্বাস করা হতো, চন্দ্রগ্রহণের সময় চাঁদের এক টুকরো খেয়ে ফেলা হয়। ম্যাক্সিকান সংস্কৃতিতে এটা বিশ্বাসে পরিণত হয়, প্রসূতি মা সূর্যগ্রহণ দেখলে তার অনাগত সন্তানের এক টুকরো খেয়ে নেবে দেবতারা!
কাত হয়ে শুতে বারণ: সূর্যগ্রহণে অন্তঃসত্ত্বা মায়েদের শান্তি নেই। সেন্ট লুইসে অবস্থিত মার্সি হাসপাতালের গাইনোকোলজিস্ট শাফিয়া ভুট্টোর মতে, সূর্যগ্রহণের সময় পাকিস্তানে মায়েদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে চিত করে শোয়ানো হতো। নইলে নাকি গর্ভের শিশু বিকলাঙ্গ হয়! বাংলাদেশেও এ ধারণার অস্তিত্ব রয়েছে। তবে গর্ভে শিশুকে রেখে চিত হয়ে শোয়াটা মায়েদের জন্য বেশ কষ্টসাধ্য ব্যাপার।
গর্ভবতী মহিলাদের উপর গ্রহণের প্রভাব: যাঁরা গর্ভবতী তাঁদের বলা হয় চন্দ্রগ্রহণ শেষ না হওয়া পর্যন্ত উপবাসে থাকতে। এছাড়াও গ্রহণের দিন কোনও সেলাই করা যাবে না। আগের দিনের রান্না ঘরে রাখা যাবে না। কাঁচি, ছুরির মতো ধারালো কিছুও থাকবে না ঘরে। সূর্যের আলো যাতে ঘরে না ঢোকে তার ব্যবস্থা করতে হবে। দরজা জানালা সব বন্ধ রাখতে হবে ইত্যাদি। আসলে এগুলোর সবই এক শ ভাগ কুসংস্কার।
ভ্রমণ না করা: সূর্যগ্রহণ চলাকালীন ভ্রমণ করলে তা অমঙ্গলজনক – এমন একটি ধারণা প্রচলিত রয়েছে অনেক মানুষের মধ্যেই। আরেকটি ধারণা রয়েছে যে, সূর্যগ্রহণের সময় ভ্রমণ করলে গ্রহণের সময় সূর্য থেকে নিঃসৃত ক্ষতিকর রশ্মি গায়ে লেগে ত্বকের ক্ষতি করতে পারে। বিশেষজ্ঞ বলচেন- গ্রহণের সময় সূর্য থেকে আলাদা কোনো ক্ষতিকর রশ্মি নিঃসরণ হয় না, কাজেই আলাদাভাবে কোনো ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে না।
গ্রহণের পর গোসল করা: সূর্যগ্রহণের ফলে তথাকথিত যেসব ক্ষতিকর রশ্মি শরীরের সংষ্পর্শে আসে, সেসব রশ্মির ক্ষতিকর প্রভাব থেকে ত্বককে রক্ষা করতে গ্রহণের শেষে গোসল করার উপদেশ দেয়া হয়ে থাকে কিছু ক্ষেত্রে। এই ধারণাটিও সম্পূর্ণ অবৈজ্ঞানিক বলে মন্তব্য করেন অধ্যাপক নওরীন আহসান।
“সাধারণ অবস্থায় সূর্যের রশ্মি গায়ে লাগলে যতটা ক্ষতি হোতো, সূর্যগ্রহণের সময় তার চেয়ে বেশি ক্ষতির সম্ভাবনা নেই। কাজেই সূর্যগ্রহণের সময় যে আলাদাভাবে অতিরিক্ত ক্ষতি হবে, এই ধারণার কোনো ভিত্তি নেই।”
ধাতব অলংকার পরা, খাবার ও টয়লেটে বারণ: ধাতব অলংকার পরতে বারণ করা আছে ‘অ্যাস্ট্রোসেইজ’ নামে এক জ্যোতির্বিদ্যা সাইটে। অন্যদিকে ম্যাক্সিকান কুসংস্কারে, গ্রহণ চলাকালীন ধাতব অলংকার পরাকে উৎসাহিত করেছে। মেক্সিকোর প্রসূতি মায়েরা পেটের কাছে ধারালো ছুরি রাখতেন যেন গ্রহণের সময় সন্তানকে ঠোঁট কাটা রোগ থেকে বাঁচানো যায়। প্রচলিত আছে, সূর্যগ্রহণের ১২ ঘণ্টা এবং চন্দ্রগ্রহণের ৯ ঘণ্টা আগে থেকে খাবার গ্রহণ করা বারণ। এ সময় যৌন সংসর্গ বারণ, নিষেধাজ্ঞা রয়েছে মলমূত্র ত্যাগেও। তবে এসব ধারণার সুস্পষ্ট কারণ উল্লেখ নেই এবং নিশ্চিত ভাবেই কোনো বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা নেই।
বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করে সূর্যগ্রহণ দেখা: সূর্যগ্রহণ দেখার ক্ষেত্রে চোখের সুরক্ষার জন্য বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করার উপদেশ দেয়া হয়ে থাকে যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ বিষয়ক সংস্থা নাসা খালি চোখে সূর্যগ্রহণ দেখা থেকে বিরত থাকতে উপদেশ দিয়েছে। সামান্য সময়ের জন্যও খালি চোখে সূর্যগ্রহণ দেখলে চোখের ক্ষতি হতে পারে বলে সতর্ক করেছে তারা।
সূর্য গিলে খাচ্ছে ড্রাগন: চৈনিক সভ্যতাসহ বেশ কিছু আমেরিকান ও ইউরোপীয় সভ্যতায় সূর্যগ্রহণের কারণ হিসেবে ড্রাগনের উল্লেখ আছে। ‘গেম অব থ্রোনস’-এর কল্যাণে পুরাকথার এই কল্পিত ড্রাগন স্থান করে নিয়েছে মানুষের কল্পনাতেও। প্রাচীন মায়া সভ্যতা ছাড়াও ‘নেটিভ’ আমেরিকানদের ‘চাকো’ জনগোষ্ঠীতে এখনো ড্রাগনের গল্প প্রচলিত।
তবে অনেক বিশেষজ্ঞ বলছেন- শুধু সূর্যগ্রহণের দিনই যে সূর্যের দিকে খালি চোখে তাকানো উচিত নয় – এমনটা নয়।
“সূর্যগ্রহণের দিন মানুষ সূর্যের দিকে খালি চোখে তাকায়, কারণ সেদিন সূর্যের প্রখরতা অন্যান্য সময়ের চেয়ে অনেক কম থাকে। তাই মানুষের অনেকক্ষণ যাবৎ তাকিয়ে থাকার সম্ভাবনা ও সুযোগ থাকে – যেটি ক্ষতির কারণ হতে পারে।”
“যে কোনো সাধারণ দিনে মানুষ সূর্যের দিকে কিছুক্ষণ তাকালেও চোখের ক্ষতি হবে। পার্থক্যটা হলো, সাধারণ দিনে মানুষ তাকায় না, সূর্যগ্রহণের সময় মানুষ তাকায়, তাই বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করতে বলা হয়”, বলেন অধ্যাপক নওরীন আহসান।