1. mahfujpanjeree@gmail.com : Mahfuzur-Rahman :
  2. admin@samagrabangla.com : main-admin :
  3. mahmudursir@gmail.com : samagra :

মহাত্মা গান্ধী ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর : মতপার্থক্য এবং পরমতসহিষ্ণুতা

  • Update Time : শনিবার, মে ৮, ২০২১

এইচ এম এ হক বাপ্পি:

ভারতবর্ষের স্বাধীনতা ও সমাজ সংস্কারের বিষয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং মহাত্মা গান্ধী একই বিন্দুতে অবস্থান করতেন। উভয়েরই ধ্যান-ধারণাই ছিল স্বদেশের মুক্তি ও অগ্রগতি। সহজাত ভাবে তাঁরা দুজনেই ছিলেন মুক্ত চিন্তা-চেতনার প্রবক্তা এবং স্পষ্টভাষী। নিজস্ব মত ও পথে অবিচল। ব্যক্তিগত ঘনিষ্ঠতা থাকলেও ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন অবসানের লক্ষ্যে গান্ধীর রাজনৈতিক ও সামাজিক দর্শন বাস্তবায়নে গৃহীত নানাবিধ পদক্ষেপের সাথে রবীন্দ্রনাথের ষ্পষ্ট মতবিরোধ ছিল।

ভারতবর্ষের উন্নয়নে রবীন্দ্রনাথ এবং গান্ধীর আন্তরিক প্রচেষ্টার দায়বদ্ধতা থেকে বিভিন্ন আন্দোলন, প্রতিবাদ কর্মসূচি সহ অনেক বিষয় নিয়েই তাঁরা তর্ক-বিতর্ক করতেন। এই বিতর্ক ব্যক্তি পর্যায় বৈঠক থেকে ভাষণ, চিঠিপত্র ছাড়িয়ে পত্রিকার পাতায় পর্যন্ত হাজির হয়েছে। ভারতবর্ষেও স্বাধীকার আন্দোলনের সমসাময়িকে গান্ধীর সবচেয়ে বড় সমালোচক ছিলেন কবিগুরু। তর্ক-বিতর্কে এই দুই মহান ব্যক্তিত্ব যুক্তি-পাল্টা যুক্তি দিয়ে নিজেদের মতামত উপস্থাপন করেছেন, তবে সে বিতর্কগুলো ছিল সহনশীল, শ্রদ্ধাপূর্ন ও সৌজন্যমূলক। মতদ্বৈততা নিয়ে স্বচ্ছ ধারণা রাখতেন বলেই তাঁরা ছিলেন পরমতসহিষ্ণু। যার ফলে মত ও পথের পাথর্ক্যেও তাদের পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ ছিল অটুট। পরমতসহিষ্ণুতা এবং সম্প্রীতির এমন দৃষ্টান্ত উপমহাদেশের ইতিহাসে বিরল।

খদ্দর ও চরকা বিতর্ক:
১৯১৯ সালের ১৩ এপ্রিল পাঞ্জাবের অমৃতসরে জালিয়ানওয়ালাবাগ নামক স্থানে এক বৈশাখী জমায়েতে নিরস্ত্র মানুষের উপর ব্রিটিশ পুলিশ বাহিনী ব্রিগেডিয়ার জেনারেল রেজিনাল্ড এডওয়ার্ড হ্যারি ডায়ারের নিদের্শে গুলিবর্ষণ করা হয়। গুলিবর্ষণে ৩৭৯ জন নিহত ও সহ¯্রাধিক মানুষ আহত হয়। আকস্মিক এ ঘটনার ভয়াবহতায় গান্ধী ব্রিটিশ সরকারকে যেকোন রকম সহযোগিতা করাকেই মহাপাপ বলে অভিহিত করে দেশব্যাপী অহিংস অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেন। এ আন্দোলনের মধ্য দিয়ে স্বরাজ প্রতিষ্ঠা করার প্রধান অস্ত্র ছিল বিলাতি পণ্য বিশেষত বস্ত্র বর্জন করে দেশি পোশাক ব্যবহার। এই কর্মসূচি ‘স্বদেশী’ নামে পরিচিত ছিল।

খদ্দরকে স্বদেশীর প্রধানতম রূপ আখ্যায়িত করে বললেন- “স্বদেশী আন্দোলনের বাস্তব এবং মূল বিষয়বস্তুই হল খদ্দর”। চরকা এবং খদ্দর ছাড়া স্বরাজ অসম্ভব জানিয়ে বললেন,“যতদিন না আমাদের লক্ষ লক্ষ ভাই-বোন চরকা ঘুরিয়ে সুতা কেটে খাদি তৈরি করে পরবে না, আমি নিশ্চিত ততদিন স্বরাজ আসবে না ”। এক বছরের মধ্যেই স্বরাজ আসার প্রতিশ্রুতি দিয়ে তিনি বলেছিলেন,“ আজও আমি দৃঢ় আত্মবিশ্বাসের সাথে বলছি, আপনারা কেবল যদি সমস্ত রকমের বিদেশী এবং ভারতীয় মিলের তৈরি কাপড় সম্পূর্ণভাবে বর্জন করেন তবে আমি বলতে পারি এক বছরেরও কম সময়ের মধ্যে স্বরাজ অর্জন করতে পারবেন”

রবীন্দ্রনাথ চেয়েছিলেন মহাত্মা গান্ধীর মুক্তির ডাক হবে জ্ঞান-বিজ্ঞান, শিল্প-সাহিত্য, রাজনীতি, কৃষি-বাণিজ্য সহ সর্বক্ষেত্রের সর্ব সাধারণের জন্য। স্থানীয় বিখ্যাত ‘মডার্ন রিভিউ’ সাময়িকীর ১৯২১-এর ২৯ অগাস্ট প্রকাশিত ‘দ্য কল অব ট্রুথ’ বা ‘সত্যের আহ্বান’ প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ লেখেন,“স্বরাজ মানে কেবল স্বদেশী কাপড় নির্মাণে স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়া নয়। এর সত্যিকারের অবস্থান আমাদের হৃদয়ে, বহুগামী শক্তিসম্পন্ন মন, এর নিজের জন্য স্বরাজ নির্মাণ করতে থাকে।” তিনি আরো লেখেন, “বিশ্বপ্রকৃতি যখন মৌমাছিকে মৌচাকের সংকীর্ণ জীবনযাত্রায় ডাক দিলেন, তখন লক্ষ লক্ষ মৌমাছি সেই আহ্বানে কর্মের সুবিধার জন্য নিজেকে ক্লীব করে দিল। আপনাকে খর্ব করার দ্বারা এই যে তাদের আত্মত্যাগ এতে তারা মুক্তির উলটো পথে গেল। যে দেশের অধিকাংশ লোক কোনো প্রলোভনে বা অনুশাসনে নিজের শক্তির ক্লীবত্ব সাধন করতে কুণ্ঠিত হয় না, তাদের বন্দিদশা যে তাদের নিজের অন্তরের মধ্যেই। চরকা কাটা একদিকে অত্যন্ত সহজ, সেই জন্যেই সকল মানুষের পক্ষে তা শক্ত। সহজের ডাক মানুষের নয়, সহজের ডাক মৌমাছির।” রবীন্দ্রনাথের দৃষ্টিতে এ আন্দোলনে চরকার সীমাহীন প্রাধান্য রাজনৈতিক দৃষ্টির সঙ্কীর্ণতা।

তিনি বলেনÑ “আজ আমাদের দেশে চরকা লাঞ্ছনা পতাকা উড়িয়েছে। এ যে সংকীর্ণ জড়শক্তির পতাকা, অপরিণত যন্ত্র শক্তির পতাকা, স্বল্পবল পণ্যশক্তির পতাকাÑএতে চিত্ত শক্তির আহ্বান নেই।” ‘সবুজপত্র’র ভাদ্র ১৩৩২ সংখ্যায় রবীন্দ্রনাথ ‘চরকা’ নামক প্রবন্ধে প্রশ্ন তোলেন, “ভারতবর্ষের তেত্রিশ কোটি লোক স্বভাব স্বাতন্ত্র নির্বিচারে এই ঘূর্ণ্যমান চরকার কাছে যে যতটা পারে আপন সময় ও শক্তির নৈবেদ্য সমর্পণ করবে চরকার কি প্রকৃতই সেই মহিমা আছে।” রবীন্দ্রনাথের দৃষ্টিতে চরকা ছিল ব্যক্তিবিশেষের যুক্তিহীন ঝোক এবং দেশবাসীর ওপর মহাত্মা গান্ধী প্রবল ব্যক্তিত্বের প্রভাব বৈ কিছু নয়। এ কারনে তিনি বলেছিলেনÑ“এই জন্যই কবুল করতে লজ্জা হচ্ছে না (যদিও লোকভয় যথেষ্ট আছে) যে, এ পর্যন্ত চরকা আন্দোলনে আমার মন ভিতর থেকে দোল খায় নি।”

বিদেশি কাপড় পরিধানকে গান্ধী ‘পাপ’ বিবেচনা করে বলেছিলেন: “বিদেশী কাপড় পরিধান করাকে পাপ হিসাবে বিবেচনা করুন। আমাকে অবশ্যই স্বীকার করতে হবে যে আমি অর্থনীতি এবং নীতিশাস্ত্রের মধ্যে নিখুঁত অথবা কোনও রকম পার্থক্য টানছি না। যে অর্থনীতি কোনও ব্যক্তি কিংবা জাতির নৈতিক কল্যাণকে আঘাত করে তা অনৈতিক এবং তাই পাপজনক” (এ গ্রেট সেন্টিনেল-ইয়াং ইন্ডিয়া, ১৩/১০/১০২১)। ‘সত্যের আহ্বান’-এ বিদেশী কাপড় বর্জনের বিষয়টিকে অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণে বিবেচনা করে বলেন, “কাপড় ব্যবহার বা বর্জনের ব্যাপারে অর্থশাস্ত্রিকতত্ত্বের ঘনিষ্ঠ যোগ আছে, এ সম্বন্ধে সেই তত্ত্বের ভাষাতেই দেশের সঙ্গে কথা কইতে হবে বুদ্ধির ভাষা মান্য করা যদি বহুদিন থেকে দেশের অভ্যাসবিরুদ্ধ হয়, তবে আর সব ছেড়ে দিয়ে ওই অনভ্যাসের সঙ্গেই লড়াই করতে হবে, কেননা ওই অনভ্যাসই আমাদের পক্ষে গোড়ায় গলদ,অরিজিনাল সিন। সেই গলদটারই খাতিরে সেই গলদকেই প্রশ্রয় দিয়ে আজ ঘোষণা করা হয়েছে বিদেশী কাপড় অপবিত্র,

অতএব তাকে দগ্ধ কর। অর্থশাস্ত্রকে বহিষ্কৃত করে তার জায়গায় ধর্মশাস্ত্রকে জোর করে টেনে আনা হলো। কিন্তু কোনো কাপড় পরা বা না পরার মধ্যে যদি কোনো ভুল থাকে, তবে সেটা অর্থতত্ত্বের বা স্বাস্থ্যতত্ত্বের বা সৌন্দর্যতত্ত্বের ভুল এটা ধর্মতত্ত্বের ভুল নয়।” অসহযোগের উন্মাদনার যুগে কৃষকদের এই বাধ্যতামূলক চরকা কাটার বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ করে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে ব্যাপক সমালোচনা সহ্য করতে হয়েছিল।

প্রচলিত ধর্মসংস্কার হতে মুক্তিই স্বরাজ অথচ অসহযোগ আন্দোলনে গান্ধী ভারতবাসীর ধর্মসংস্কারকে ব্যবহার করছেন বলে ‘সত্যের আহ্বান’ প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ লেখেন “যে কলের দৌরাত্ম্যে সমস্ত পৃথিবী পীড়িত, মহাত্মাজী সেই কলের সঙ্গে লড়াই করতে চান, এখানে আমরা তাঁর দলে। কিন্তু যে মোহমুগ্ধ, মন্ত্রমুগ্ধ, অন্ধবাধ্যতা আমাদের দেশের সকল দৈন্য ও অপমানের মূলে, তাকে সহায় করে এ লড়াই করতে পারব না। কেননা তারই সঙ্গে আমাদের প্রধান লড়াই, তাকে তাড়াতে পারলে তবেই আমরা অন্তরে বাহিরে স্বরাজ পাব।”

কবিগুরুর ‘সত্যের আহ্বানে’র জবাবে ১৯২১-এর ১৩ অক্টোবর সংখ্যার ‘ইয়ং ইন্ডিয়া’ প্রকাশ করে গান্ধীর ‘এ গ্রেট সেন্টিনেল’ বা মহান প্রহরী প্রবন্ধটি যা পৃথিবীর যেকোনো সাহিত্যে সেরা রচনার তালিকায় স্থান পাওয়ার যোগ্য বলে আজও বিবেচিত হয়। প্রবন্ধে গান্ধী কবিগুরুর চরকা সম্পর্কিত সমালোচনার প্রশংসা করে গান্ধী অত্যন্ত সংযত ভাষায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বক্তব্যের জবাবে বলেন, “কবির ভাবনা চরকা জাতির জন্য এক মৃত্যুবাণ। প্রকৃত সত্য হলো চরকা আমাকে অপরিহার্যভাবে একজন রাজপুত্রের মহিমায় অভিষিক্ত করেছে। একজন চাষা ও রাজপুত্রের মধ্যে কোনো তফাত্ নেই। চরকা আমাকে শ্রমের মর্যাদা দান করেছে। কবি কেবল ‘সত্যের আহ্বান’-এ নয়, ‘চরকা স্তুতি’-তেও প্রশ্ন তুলেছেন। কবির প্রশ্ন, আমি কেন সংকীর্ণভাবে বার বার সূতা কাটা ও কাপড় বোনার কথা বলছি।

তাঁর আরও অভিযোগ আমি কেন দেশের সকল শক্তিকে একত্রিত করে কাজে নামছি না! প্রতিবেশী শস্যভান্ডারের মালিককে গ্রাহকের অভাবে উপোসে রেখে বিদেশি কাপড় পরা ও আমেরিকার গম খাওয়াকে আমি পাপ মনে করি। আমার এই পাপ ধুয়ে ফেলার জন্য বিদেশি কাপড়কে পুড়িয়ে উদোম শরীরকে চরকায় তোলা সূতা দিয়ে বোনা কাপড় দিয়ে ঢাকতে চাই। আমার দেশে নগ্ন মানুষকে কাপড় দেওয়ার পরিবর্তে কাজ দেওয়া অবশ্যই শ্রেয় মনে করি। তাদের জন্য কাজের সংস্থান খুব প্রয়োজন। নগ্ন দেহ না ঢেকে অপরিহার্য কাজের সংস্থানকেও আমি পাপ মনে করি, যা আমি করতে পারি না”।

চরকা ব্যবহার বা বিদেশী কাপড় বর্জন কোন আবেগপ্রবন সিদ্ধান্ত নয় জানিয়ে তিনি বলেন,“বিদেশী কাপড়ের প্রতি আমাদের আসক্তি চরকার মর্যাদা হরণ করেছে। তাই বিদেশী কাপড় পরা আমি পাপ মনে করি। বিদেশী কাপড় পুড়িয়ে আমি আমার অপমানকেই দগ্ধ করি।” ভারতের দারিদ্র দূরীকরণে গ্রামীন প্রেক্ষাপটকে গুরুত্ব দিয়ে গান্ধী বলেন,“… শহরগুলোই আমাদের দেশ নয়। সাড়ে সাত লক্ষ গ্রামই আমাদের দেশ এবং ওই গ্রামগুলোর ওপরই টিকে থাকে শহর। অন্য দেশ থেকে তারা কোনো সম্পদ আনে না। শহরের মানুষ হলো ইউরোপ আমেরিকা ও জাপানের বড় বড় কারবারের দালাল আর কমিশন এজেন্ট।

ওইসব কারবারের সঙ্গে জোট বেঁধে শহর দুশ বছর ধরে দেশের রক্ত শুষে নিয়েছে। আমার বিশ্বাস, দেশ ক্রমাগত গরিব হচ্ছে। তার পায়ে রক্তসঞ্চালন প্রায় বন্ধ এবং আমরা যদি সতর্ক না হই, তবে তার বিনাশ অনিবার্য।” তারপর তার সেই স্মরণীয় উক্তি, ‘ক্ষুধার্ত ও বেকার জনগণের কাছে ঈশ্বর কেবল একটিমাত্র রূপেই দেখা দেবার কথা ভাবতে পারেন, আর তা হলো খাবার এবং খাবারের প্রুতিশ্রুতি নিয়ে কাজ। ঈশ্বর কাজ করে খাবার জন্যে মানুষ সৃষ্টি করেছিলেন এবং বলেছিলেন, কাজ না করে যারা মুখে খাবার তোলে, তারা তস্কর।”

অসহযোগ আন্দোলন মতবিরোধ:
মহাত্মা গান্ধী যখন অসহযোগ আন্দোলন শুরু করেন কবি তখন আমেরিকা সফরে ছিলেন। ভারতে ফিরে তিনি ‘সত্যের আহ্বান’- এ অসহযোগ আন্দোলনকে রাজনৈতিক সন্ন্যাস বলে পরিহাস করে বলেনÑ “এতদিন পরে আমার দেশে সেই আনন্দময় মুক্তির হাওয়া বইছে, এইটেই আমি কল্পনা করে এসেছিলুম। এসে একটা জিনিস দেখে আমি হতাশ হয়েছি। দেখেছি, দেশের মনের উপর বিষম একটা চাপ। বাইরে থেকে কিসের তাড়নায় সবাইকে এক কথা বলাতে, এক কাজ করাতে ভয়ংকর তাগিদ দিচ্ছে।…কথা উঠেছে সমস্ত দেশের বুদ্ধিকে চাপা দিতে হবে, বিদ্যাকেও। কেবল বাধ্যতাকে আঁকড়ে ধরে থাকতে হবে। কার কাছে বাধ্যতা? মন্ত্রের কাছে, অন্ধ বিশ্বাসের কাছে?”। অসহযোগ আন্দোলন পাশ্চাত্য এবং প্রাচ্যের সম্পর্ক বিনষ্ট করবে মন্তব্য করে সি. এফ এন্ড্রুজকে দেয়া এক চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ লেখেন Ñ“আমাদের সমগ্র হৃদয়-মনকে পাশ্চাত্যের প্রতি বিদ্বিষ্ট করিয়া তুলিবার এই যে বর্তমান সংগ্রাম ইহা একটি আধ্যাত্মিক আত্মঘাতের চেষ্টা মাত্র।” গান্ধীর বন্ধু চার্লস ফ্রিয়ার এন্ড্রুজও কবিগুরুকে সমর্থন করেছিলেন।

ব্যক্তিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ের সকল সমস্যা সমাধানে অহিংসা এবং মৈত্রীতে বিশ^াসী গান্ধী বলতেন, “অহিংসার অর্থ অন্যায়কারীর নিকট নতি স্বীকার নয়। অহিংসার অর্থ স্বৈরাচারী ইচ্ছাশক্তির বিরুদ্ধে নির্যাতিতের সমগ্র আত্মার বোধকে উত্থিত করা।” এই অহিংসা বাণী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শ্রদ্ধা ও সমর্থন করলেও অসহযোগ আন্দোলনে এর প্রয়োগ নিয়ে দ্বিমত পোষণ করেছিলেন। ‘প্রবাসী’ পত্রিকায় ১৩৪৬ বঙ্গাব্দের আষাঢ় মাসে প্রকাশিত একটি চিঠিতে অহিংস আন্দোলন সম্পর্কে দেশবাসীর সঠিক ধারণা নিয়ে সন্দিহান রবীন্দ্রনাথ কবি অমিয় চক্রবর্তীকে লেখেনÑ“হঠাৎ সেই তামসিকতার মধ্যে দেশের সুপ্ত প্রাণে কে ছুইয়ে দিলে সোনার কাঠি, জাগিয়ে দিলে একমাত্র আত্মশক্তির প্রতি ভরসাকে, প্রচার করলে অহিংস সাধনাকেই নির্ভীক বীরের সাধনারূপে।

নব জীবনের তপস্যার সেই প্রথম পর্ব আজও সম্পূর্ণ হয়নি, আজো এ রয়েছে তারই হাতে যিনি একে প্রবর্তিত করেছেন।…” রাজনৈতিক লক্ষ্য অর্জনে অহিংসার প্রয়োগ কতটুকু বাস্তব সম্মত এ বিষয়টি নিয়ে শংকিত রবীন্দ্রনাথ গুজরাটের বিখ্যাত কবি এবং সাহিত্যিক নানা লাল দলপতরামকে এক চিঠিতে লেখেনÑ “জগতের মহাপুরুষগণ প্রেম, ক্ষমা ও অহিংসার বাণী প্রচার করিয়া গিয়াছেন; কিন্তু তাঁহারা ইহা করিয়াছেন মুখ্যতঃ অধ্যাত্ম পরিপূর্ণতা লাভের জন্য; কিন্তু কোনও রাজনৈতিক সমূহ-উদ্দেশ্য সিদ্ধির জন্য অথবা জীবনের সমজাতীয় ক্ষেত্রের কোনও উদ্দেশ্য সাধনের জন্য ইহা প্রচার করেন নাই।” এ বিষয়ে গান্ধীর মত ও বিশ্বাস ছিল ভিন্ন। অহিংসাকে যদি আত্মিক শক্তি বলে স্বীকার করা যায় এবং সে শক্তিকে যদি সর্বশ্রেষ্ঠ শক্তি বলে স্বীকার করা যায় তবে তার প্রয়োগক্ষেত্রকে সীমাবদ্ধ রাখবো কেন? জীবনের সকল ক্ষেত্রে প্রয়োগ করে তবেই তো তার সত্যের প্রতিষ্ঠা।

জাতীয়তাবাদ ও আন্তর্জাতিকতাবাদের মধ্যকার দূরত্ব সমন্ধে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বক্তব্য ছিল, জাতীয়তাবাদীরা সবসময় আত্মকেন্দ্রিক হয়ে নীতিভ্রষ্টতার পথে চলেন। বিদেশি কাপড় পোড়ানো আত্মকেন্দ্রিক জাতীয়তাবাদ। গান্ধী জবাবে বলেন যে, জাতীয়তাবাদী না হলে কেউ আন্তর্জাতিকতাবাদী হতে পারেন না।

হিন্দু-মুসলমান জাতিগত দ্বন্দ্বে তৃতীয়পক্ষের অস্তিত্বে মহাত্মা গান্ধীর বিশ^াস এবং এ সমস্যা নিরসনে তাঁর ভূমিকা রবীন্দ্রনাথের অপছন্দ ছিল। রবীন্দ্রনাথের বিশ^াস ছিল যে হিন্দু-মুসলিম জাতিগত দ্বন্দ্বের বীজ প্রচলিত সমাজ জীবনের মাঝেই রোপিত আছে। ‘লোকহিত’ প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেনÑ“সংস্কৃত ভাষায় একটি কথা আছে, ঘরে যখন আগুন লাগিয়াছে তখন কূপ খুঁড়িতে যাওয়ার আয়োজন বৃথা। বঙ্গবিচ্ছেদের দিনে হঠাৎ যখন মুসলমানকে আমাদের দলে টানিবার প্রয়োজন হইল তখন আমরা সেই কূপ খননের চেষ্টা করি নাই। আমরা মনে করিয়াছিলাম, মাটির উপরে ঘটি ঠুকিলেই জল আপনি উঠিবে। জল যখন উঠিল না, কেবল ধূলাই উড়িল, তখন আমাদের বিস্ময়ের সীমা পরিসীমা রহিল না। আজ পর্যন্ত সেই কূপ খননের কথা ভুলিয়া আছি।”

অসহযোগ আন্দোলন রবীন্দ্রনাথের নিকট ছিল নিছক এক নেতিবাচক কর্মসূচি। তিনি ১৮ই সেপ্টেম্বর ১৯২০ তারিখে প্যারিস থেকে সি. এফ এন্ড্রুজকে লেখা একটি চিঠিতে বলেনÑ“এ ব্যাপারে মহাত্মা গান্ধী একজন সত্যিকার নেতা হয়ে উঠুন; তিনি গঠনাত্মক সেবা কার্যের জন্য সকলের নিকট আহ্বান পাঠান; কিন্তু সকলকে ত্যাগের শ্রদ্ধাঞ্জলি দিতে আহ্বান করুণÑ যে ত্যাগ পরিণতি লাভ করে প্রেমে এবং সংগঠনে। সেবায় ও প্রেমে তিনি যদি আমাদের দেশের লোকের সহিত সহযোগিতার জন্য আমাকে কোনো আদেশ করেন তবে আমি তাঁহার পায়ের কাছে বসিয়া তাঁহার সেই সব নির্দেশ পালন করতে রাজি আছি।

ক্রোধের আগুন জ্বালাইয়া এবং ঘরে ঘরে আগুন ছড়াইয়া দিয়া আমার মনুষ্যত্বের অপচয় করিতে আমি অস্বীকার করি।” রবীন্দ্রনাথের উৎকন্ঠা আরো বৃদ্ধি পায় যখন অসহযোগে যোগ দিতে দলে দলে শিক্ষার্থীরা সরকারি স্কুল বর্জন করতে থাকে। এই আন্দোলন অজ্ঞানতাকে প্রশ্রয় দিয়ে দেশকে সংকীর্ণতার দিকে, চিন্তায় জড়ত্বের দিকে টেনে নিয়ে যাবে ভেবে ভীত-সংক্ষুব্ধ কবি গান্ধীর কঠোর সমালোচনা করেন।

অসহযোগ আন্দোলন সম্বন্ধে কবিগুরুর মতামত সম্বলিত যে তিনটি প্রবন্ধ ‘মডার্ণ রিভিউ’তে প্রকাশিত হয়েছিল ১৯২১-এর ১ জুনের ইয়ং ইন্ডিয়া পত্রিকায় গান্ধী তার জবাব দেন। রবীন্দ্রনাথের সমালোচনার প্রতি সম্মান রেখেই তিনি ‘কবির দুশ্চিন্তা’ নামক প্রবন্ধে লেখেন- “…আমি কবিকে এবং ভারতবর্ষকে এই নিশ্চিত আশ্বাস দিতেছি, তিনি অসহযোগের ধারণা সম্বন্ধে যে-সব আশঙ্কা পোষণ করিতেছেন, অসহযোগ তাহার কিছুই নয়, এবং তাহার দেশ অসহযোগ গ্রহণ করিয়াছে বলিয়া তাঁহার লজ্জিত হইবার কোন কারণ নাই।… কিন্তু ভারতবর্ষের পক্ষে হিংসা অথবা অসহযোগÑ এই উভয়েরই কোনো একটি ব্যতিত আর অন্য কিছু নির্বাচন করিবার নাই।

ভারতবর্ষ এবং পাশ্চাত্যের মধ্যে একটি চীনের প্রাচীর গড়িয়া দেওয়ার জন্যই অসহযোগের উদ্ভাবন কবির পক্ষে এইরূপ আশঙ্কাও নিষ্প্রয়োজন। বরঞ্চ পারস্পারিক শ্রদ্ধা ও বিশ্বাসের উপরে প্রতিষ্ঠিত সত্যিকারের এবং সম্মানজনক ও স্বেচ্ছাপ্রণোদিত সহযোগিতার পথ গড়িয়া তুলিবার উদ্দেশ্যই হইল এই অসহযোগের। বর্তমানের যে সংগ্রামÑএ সংগ্রাম হইল বাধ্যতামূলক সহযোগিতার বিরুদ্ধে, এক-তরফা মিলনের বিরুদ্ধে, সভ্যতার নামে একটি ছদ্মবেশে শোষণের সকল আধুনিক পন্থা প্রয়োগের যে সশস্ত্র চেষ্টা তাহারই বিরুদ্ধে।…অসহযোগ হইল নিজেদের অজ্ঞাতে এবং নিজেদের অনিচ্ছায় যে অন্যায়ের অংশগ্রহণ তাহার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ।”

ছেলেমেয়েদের সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বর্জনের ডাক সমর্থন করে তিনি লেখেন, ‘সরকারি শিক্ষাব্যবস্থা আমাদের মনুষ্যত্বকে অবদলিত করেছে… আমাদের তা যা করার তাই করেছে: কেরানি আর দোভাষী। আপাতদৃষ্টে শাসিতের স্বেচ্ছায় সহযোগিতা করা যদি অন্যায় বলে মনে করি, তবে সেসব প্রতিষ্ঠানই আমাদের সবার আগে ধরা দরকার, যেখানে আমাদের সংযোগ মনে হয় সবচেয়ে স্বতঃস্ফূর্ত। যুবশক্তি একটি দেশের আশা-ভরসা। যে মুহূর্তে আমরা বুঝতে পারি, এ শাসনব্যবস্থা পূর্ণত অথবা প্রধানত অমঙ্গলের প্রতিভূ, তখনই আমি মনে করি, আমাদের ছেলেমেয়েদের তার সঙ্গে যুক্ত করার যেকোনো প্রয়াসই হবে পাপ।’

অসহযোগ নেতিবাচক এমন অভিযোগের জবাবে গান্ধী বলেন, “আমি মনে করি, কবি অসহযোগের নেতিবাচক দিক নিয়ে অহেতুক উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন। আমরা ‘না’ বলার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছিলাম। সরকারের মুখের ওপর ‘না’ বলাটা মনে করা হতো আনুগত্যহীনতা, প্রায় এক অপবিত্র অপকর্ম।…অসহযোগ প্রকৃতপক্ষে সরকারের কাছে জাতির দেয়া শর্ত মেনে সহযোগিতারই আহ্বান। ওই শর্ত প্রতিটি জাতির স্বাভাবিক অধিকার এবং তা মানা প্রতিটি সুশাসকের অবশ্য কর্তব্য।”

মহান প্রহরী প্রবন্ধে সত্য ও যুক্তির পক্ষে দাঁড়ানোর জন্যে তিনি কবিগুরুকে গভীর কৃতজ্ঞতা জানান। অসহযোগকে ‘সাময়িক নিজেদের মধ্যে ফিরে আসা’ উল্লেখ করে তিনি বলেন, “আমরা নিজেদের মধ্যে নিজেরা অত্যন্ত দুর্বল হয়ে পড়েছি। এত দুর্বল হয়েছি যে অপরের সঙ্গে আমাদের সহযোগিতার অর্থ দাসত্ব বরণ করে নেয়া ছাড়া আর কিছুই না Ñ শারীরিক মানসিক আধ্যাত্মিক সকল প্রকার দাসত্ব। নিজেদের মধ্যে নিজেরা কিছুদিন ফিরে এসে দৃঢ় ভিত্তিতে নিজেদের গড়িয়া লইতে হইবেÑ তাহাতে আমরা সমগ্র মানবজাতির সেবা করিবার জন্য দেহে ও মনে যথেষ্ট শক্তি সঞ্চয় করিয়া লইতে পারি।” “আমি চাই সব দেশের সংস্কৃতি আমার ঘরে যতটা সচ্ছন্দে সম্ভব ততটা সচ্ছন্দেই বহিয়া আসুক, …কিন্তু তাহার কোনোটা আসিয়া আমাকে উড়াইয়া লইয়া যাক ইহা আমি চাহি না। বন্দীশালার ধর্ম আমার ধর্ম নয়।

আমার ঘরে ভগবানের সৃষ্ট জীবের মধ্যে ক্ষুদ্রতমের জন্যও স্থান আছে, কিন্তু আমার ঘরকে আমি জাতি-ধর্ম ও বর্ণ লইয়া উদ্ধত অপমানকর দম্ভের বিরুদ্ধে দুর্ভেদ্য করিয়া তুলিতে চাই।”

অসহযোগ আন্দোলনের ব্যাপারে রবীন্দ্রনাথের সংশয় ও সতর্ক বাণীর মধ্যে দূরদর্শিতার পরিচয় দিয়েছিলেন যা পরবর্তীতে কতগুলো ঘটনা প্রমাণ করে। পরিশেষে গান্ধীকেও আন্দোলন স্থগিত করতে হয়।

রক্ষণশীলতা বনাম বিজ্ঞান:
রক্ষণশীলতা, বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তি বিষয়ক চিন্তাধারা নিয়ে গান্ধীও রবীন্দ্রনাথ নানান প্রবন্ধ-ভাষণ ও আলোচনায় এ বিষয়ে তাঁদের মতামত ব্যক্ত করেছেন। তাঁরা উভয়েই ছিলেন বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তির সপক্ষে। প্রযুক্তির সাথে মানুষের সম্পর্ক অপরিহার্য হলে চলবে না অর্থাৎ যন্ত্রকে সুনিয়ন্ত্রিতভাবে পরিচালিত করবে মানুষ তার প্রয়োজনে। প্রযুক্তি মানুষকে পরিচালনা করলে তা হবে মানুষের জন্য হবে আত্মঘাতি। গান্ধী ও রবীন্দ্রনাথের সমসাময়িক কালের কয়েকটি প্রেক্ষাপটে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি এবং ধর্ম ও রক্ষণশীলতা সম্পর্কিত বিষয়ে তাদের মানসিক কাঠামোর মৌলিক পার্থক্য স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল।

১৫ ই জানুয়ারী ১৯৩৪ তারিখে ভয়াবহ ভূমিকম্পে পাটনা-বিহার বিধ্বস্ত হয়। দক্ষিণ ভারত সফররত মহাত্মা গান্ধী ‘হরিজন’ পত্রিকায় প্রেরিত প্রেস বিবৃতিতে বলেন, বিহারের বর্ণ-হিন্দুদের অস্পৃশ্যতা-পাপই ঐ ধ্বংসলীলার মূল কারণ। রুদ্র বিধাতার কাছ থেকেই পাপের শাস্তি রূপেই ধ্বংসের কঠোর শাস্তি নেমে এসেছে।
মহাজাগতিক ঘটনাকে নীতি-নৈতিকতার সাথে সম্পর্কিত করার এই অবৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণে রবীন্দ্রনাথ বিস্মিত হন। উদ্বিগ্ন রবীন্দ্রনাথ বিবৃতিটি গান্ধীর তা নিশ্চিত হয়ে ইউনাইটেড প্রেসে পাল্টা বিবৃতি প্রদান করেন। “প্রকৃতির জড় ঘটনাসমূহের একটি বিশেষ সমবায়ই হইল প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের অনিবার্য এবং একমাত্র কারণ।

বিশ্ব-বিধান সমূহ অলঙ্ঘ্য; এই বিধানগুলোর কাজে ঈশ্বর নিজেও কোনদিন হস্তক্ষেপ করেন না। যদি করিতেন তবে তিনি নিজেই তাঁহার নিজের সৃষ্টির সামগ্রিক সততা নষ্ট করিয়া দিতেন।” “আমরা যদি আমাদের নৈতিক সত্যগুলোকে বাহ্যসৃষ্টির ঘটনাসমূহের সঙ্গে মিশাইয়া ফেলি তাহা হইলে আমাদিগকে স্বীকার করিতে হইবে যে নৈতিক দিক দিয়া বিধাতা হইতে মানবপ্রকৃতি অনেক বড়; কারণ, দেখা যাইবে সৎচরিত্র-শিক্ষার প্রচারের জন্য তিনি এমন বিপর্যয় ঘটাইয়া বসেন যাহা সর্বনিকৃষ্ট চরিত্রের পরিচায়ক।” “আমাদের দিক হইতে এই বিশ্বাসেই নিজেদেরকে আমরা সম্পূর্ণ নিরাপদ মনে করিতেছি যে আমাদের পাপ এবং ভুলভ্রান্তি যত বিপুলই হোকÑ তাহারা এত শক্তিশালী কখনই নয় যাহাতে সৃষ্টির কাঠামোটিকেই নি¤েœ টানিয়া লইয়া একবারে ধ্বংস করিয়া দিতে পারে।” কুসংস্কার মুক্তির অগ্রদূত গান্ধীর

‘অযুক্তি’কে উৎসাহ দেয়া ‘গভীর আঘাত’-এর কারণ উল্লেখ করে রবীন্দ্রনাথ লেখেনÑ“মহাত্মাজি তাঁহার বিস্ময়কর প্রেরণা দ্বারা দেশবাসীর মনে যে ভয় ও ভীরুতা সঞ্চিত ছিল তাহা হইতে সকলকে মুক্তির জন্য উদ্বুদ্ধ করিতে পারিয়াছেন; তাহার জন্য তাঁহার কাছে আমরা যাহারা অশেষভাবে কৃতজ্ঞ বলিয়া মনে করি তাহারাই আবার মনে অত্যন্ত বেদনা বোধ করি যখন দেখি যে মহাত্মার মুখ হইতে এমন বাণী নিঃসৃত হইতেছে যাহা সেই সব দেশবাসীর মনে অযুক্তির উপাদানসমূহকে বড় করিয়া তুলিতে পারেÑ এই অযুক্তিই হইল সকল অন্ধ শক্তির মূল আকরÑযাহা আমাদিগকে জোরপূর্বক স্বাধীনতা ও আত্ম-সম্মানের পথ হইতে দূরে সরাইয়া লইতে পারে।”

গান্ধী ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রমাণ করা যেমন দুষ্কর তমনি ভূমিকম্প এবং অস্পৃশ্যতার মধ্যে যুক্তি নির্ভর ব্যাখ্যা দেয়া অসম্ভব জানিয়ে ১৬/২/১৯৩৪ তারিখে ‘হরিজন’ পত্রিকায় লেখেন “তিন্নেভেলিতে বসে আমি প্রথমে যখন বিহারের বিপৎপাতকে অস্পৃশ্যতার সঙ্গে যুক্ত করিয়াছিলাম তখন আমি যতদূর সম্ভব চিন্তা-ভাবনা করিয়াই বলিয়াছিলাম এবং সে কথা আমার পরিপূর্ণ অন্তর হইতে প্রকাশ পাইয়াছিল। আমি যেমন যা বিশ্বাস করি তাই বলিয়াছি। ” “…গুরুদেবের সাথে আমিও বিশ্ব বিধানের অমোঘতা’য় বিশ্বাস করিÑ‘যাহার ভিতরে ভগবান নিজেও হস্তক্ষেপ করেন না।’ এর কারণ ঈশ্বর নিজেই বিধান। কিন্তু এক্ষেত্রে আমার নিবেদন, আমারা বিধানকে বা বিধানসমূহকে পূর্ণভাবে জানি না, আমাদের নিকট যা একটা সর্বনাশ বলিয়া মনে হয় তা ঐরূপ মনে হওয়ার কারণ নাই যে, আমরা বিশ্ববিধান সমূহকে যথোপযুক্তভাবে জানি না।…” রবীন্দ্রনাথের তীব্র প্রতিবাদেও মহাত্মা গান্ধী তাঁর মন্তব্যের ওপর স্থির থেকেই জানান “গুরুদেবের সঙ্গে আমি এ কথায় একমত না যে, ‘আমাদের পাপ ভুলভ্রাান্তি যত বিপুলই হোকÑতারা এত শক্তিশালী কখনই না যাহাতে সৃষ্টির কাঠামোটাকে নিচে টানিয়া নিয়া একেবারে ধ্বংস করিয়া দিতে পারে।’

অপর পক্ষে আমার বিশ্বাস, অন্য কোনও প্রাকৃতিক ঘটনা অপেক্ষা আমাদের নিজেদের পাপসমূহ এই কাঠামোটিকে ধ্বংস করিয়া দিতে অধিক শক্তিশালী।” এই বিতর্কটি গান্ধীর একটি স্ববিরোধি মন্তব্যের কারণে দৃষ্টি কেড়েছিল। ‘যদি অস্পৃশ্যতা ও ভূমিকম্পের যোগসূত্র নিয়ে আমার বিশ্বাস ভিত্তিহীনও হয়, তা হলেও সেটি আমার এবং আমার মতো যাদের বিশ্বাস, তাদের জন্য মঙ্গলজনক।’ অর্থাৎ, বৃহত্তর স্বার্থে তিনি ভ্রান্ত পথকে বেছে নিতে রাজি। গান্ধীর সবসময় বলতেন, পথ যদি ভুল হয় তা হলে লক্ষ্যও ভুল হবে। অথচ রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে বিতর্কে ঠিক তার বিপরীত একটি অবস্থান গ্রহন করলেন।

রক্ষণশীলতার খাতিরে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিকে অগ্রাহ্য করতেন গান্ধী। জন্মনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা প্রচলন কেন্দ্রিক একটি ঘটনা তার উদাহরণ। অহিংসা এবং ধর্মীয় উদারতার গরীয়ান গান্ধী সামাজিক ভাবে আদ্যন্ত রক্ষণশীল এক মানুষ। যৌনতা সমন্ধে তাঁর আজীবনের বদ্ধমূল ধারণাই ছিল যে, শারিরিক সম্পর্ক কেবল বংশরক্ষার জন্যই। ১৯২৫-এ গান্ধী ‘ইয়ং ইন্ডিয়া’-তে প্রকাশিত একটি প্রবন্ধে প্রথম জন্মনিয়ন্ত্রণ সম্পর্কে তাঁর ভাবনাটি জানান। লেখাটির প্রতিবাদে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে “জন্ম নিরোধক” শব্দের প্রচলনকারী ও সর্ব প্রথম জন্ম নিরোধক ক্লিনিকের প্রতিষ্ঠাতা মার্গারেট হিগিন্স স্যাঙ্গার একটি প্রবন্ধ লেখেন। একই সাথে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকেও চিঠি পাঠান। স্যাঙ্গার-এর সমর্থনে তৎক্ষণাৎ রবীন্দ্রনাথ যে চিঠিটি পাঠান, তা ছিল গান্ধী-ভাবনার সম্পূর্ণ বিরোধী। অপরিকল্পিত পরিবারের কারণে অসংখ্য শিশুর অভাব ও অকালমৃত্যুকে তিনি সামাজিক অন্যায় বলে মন্তব্য করেন। রবীন্দ্রনাথ কিংবা স্যাঙ্গার, কেউই যে গুজরাটি রাজনীতিবিদকে তাঁর দীর্ঘলালিত ধারণা থেকে বিন্দুমাত্র সরাতে পারেননি, তা দশ বছর পর ১৯৩৫-এ স্যাঙ্গারের ভারত সফরে ষ্পষ্ট হয়।

এ সফওে ব্যক্তিগত সাক্ষাতে গান্ধী স্যাঙ্গারকে বুঝিয়েছিলেন যৌনতা ও পাপের সমানুপাতিক সম্পর্কটি। তাঁর মতে অসংখ্য সন্তান উৎপাদন দরিদ্র দেশে অবশ্যই অন্যায় এবং তার একমাত্র সমাধান যৌন সঙ্গম থেকে স্বেচ্ছায় বিরত থাকা। কৃত্রিম জন্মনিয়ন্ত্রণ মানেই মানুষের নিরর্থক যৌনতাকে উৎসাহিত করা। স্যাঙ্গার প্রশ্ন করেন, শুধুমাত্র সন্তানলাভের ইচ্ছেতেই বছরে দু-একবার যৌনমিলন করবেন এতটা নিয়ন্ত্রণ কি স্বামী-স্ত্রীর ভেতর আদৌ সম্ভব? গান্ধীর উত্তর ‘সগর্বে বলব যে আমি ঠিক সেটিই করেছি’ এবং পাল্টা প্রশ্ন করেন, কেন এই শিক্ষাটি দেওয়া যাবে না যে চারজনের বেশি সন্তানের জন্ম দেওয়া নৈতিক ভাবে অন্যায় এবং চার জনের জন্মের পর স্বামী-স্ত্রীর পৃথক শয্যায় শয়নই বাঞ্ছনীয়। ১৯৩৯ সালেও গান্ধী লিখছেন ‘যৌন বাসনা খুবই সুন্দর এবং মহৎ। তা নিয়ে লজ্জা পাওয়ার কিছু নেই। কিন্তু সেটি শুধু (সন্তান) উৎপাদনের জন্য। তার অন্য কোনও ব্যবহার ঈশ্বর এবং মানবজাতির বিরুদ্ধে পাপ’।

শান্তিনিকেতন এবং বিশ্বভারতী:
শান্তিনিকেতন এবং বিশ্বভারতীর পরিচালন ব্যয় মেটাতে শান্তিনিকেতনের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের নিয়ে রবীন্দ্রনাথ দেশের বিভিন্ন স্থানে সঙ্গীত, নৃত্য বা নাট্যাভিনয়ের আয়োজন করতেন। গান্ধী মনে করতেন বিষয়টি রবীন্দ্রনাথের ব্যক্তিত্বের সাথে দারুন বেমানান এবং বিশ্বভারতীর সম্বন্ধে রবীন্দ্রনাথের পরিকল্পনা বাস্তবায়নের আর্থিক দায়িত্ব পুরো দেশের। রবীন্দ্রনাথ বৃদ্ধ বয়সে একবার অর্থসংগ্রহের জন্য উত্তর ভারত অঞ্চলে সফরে বের হলে গান্ধী ব্যথিত হলেন।

দিল্লীতে কবির সঙ্গে সাক্ষাৎ করে শান্তিনিকেতনে ফেরত পাঠালেন। ১৩/১০/১৯৩৫ তারিখে ওয়ার্ধা থেকে পাঠানো চিঠিতে কবিকে লিখলেনÑ “এ-কথা আমার নিকট ভাবনার অতীত বলে মনে হইতেছে যে আপনার এই বয়সে আপনাকে আবার ভিক্ষার উদ্দেশ্যে বাহির হইতে হইবে, আপনার শান্তিনিকেতনের বাইরে পা বাড়ান ব্যতিতই এই অর্থকে আপনার নিকট পৌঁছাইতে হইবে।” গান্ধীর অনুরোধে ব্যবসায়ীরা রবীন্দ্রনাথের নিকট ৬০ হাজার টাকা পৌঁছে দিলেন যা শান্তিনিকেতনকে বেশ কিছু ঋণ মুক্ত করে। তবে গান্ধী তাঁর পত্রে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গীত-নৃত্য-নাট্যাভিনয়ের দলীয় সফরকে ‘বেগিং মিশন’ অভিহিত করায় কবি মন ভিষন ভাবে ব্যাথিত হয়।

কবির কাছে এসব সফর কেবল আর্থিক প্রয়োজন মিটানোই নয় বরং নিজের সৃষ্টির রূপায়ন দেখে আনন্দিত হবার দারুন সুযোগ ছিল। সঙ্গীত-নৃত্য-নাট্যাভিনয় উপভোগ করতে আসা দর্শক-শ্রোতাদের নিকট কবিগুরুর উপস্থিতিও ছিল বিরাট প্রাপ্তি। সংগত কারনেই এসব সফরকে অর্থ ভিক্ষার অভিযান নয় আনন্দ-পরিবেশনের মধ্য দিয়ে মানুষের রুচি-আচরণ ও মূল্যবোধ উন্নত করার মহৎ দায়িত পালন জানিয়ে ২৬/২/১৯৩৭ তারিখে রবীন্দ্রনাথ একটি চিঠি লেখেন Ñ“আমার দিক হতে অকপটে আপনাকে একটা কথা বলতে দিন। আমি যে কাজকে সানন্দে আমরা নিজের ব্রত বলে মনে করি সম্ভবত আপনার নিজের ধাতটি সে ব্রতের মহিমা উপলব্ধি করতে আপনাকে বাধা দেয়। আমার এই যে ব্রত তাহা ভারতবর্ষের কেবলমাত্র কোনো আর্থিক সমস্যা লইয়া ব্যস্ত নয়Ñ ভারতবর্ষের কোন সাম্প্রদায়িক ধর্মমত লইয়াও ব্যস্ত নয়Ñ ইহা একটা ব্যাপক অর্থে মানবমনের সংস্কৃতিকেই ধারণ করে আছে।

আমার মতে আমার একটি কবি-সৃষ্টিকে আমি যখন বাহিরে পাঠাইয়া দিবার জন্য ভিতরে তাগিদ বোধ করি তখন আমি শুধু ভিক্ষা বা কোনো উপকার আশা করি না; আমার এই কবি সৃষ্টিকে সাড়া দেবার মত যাঁহাদের মধ্যে একটি সংবেদনশীল হৃদয় রহিয়াছে তাঁহাদের নিকট হইতে আমি আশা করি আমার সৌন্দর্যসৃষ্টির প্রতি একটি সকৃতজ্ঞ শ্রদ্ধার্ঘ্য।”

শেষ বয়সে রবীন্দ্রনাথ ব্যক্তিগত সিদ্ধান্তে যোগ্য পথ-নির্দেশক হিসেবে গান্ধীকে বিশ্বভারতীর একজন আজীবন ট্রাস্টি হিসেবে মনোনীত করেন। এ ব্যাপারে গান্ধীকে ১০/২/১৯৩৭ তারিখে একটি চিঠিতে লেখেনÑ “আমি আপনাকে আমাদের বিশ্বভারতীর একজন আজীবন- ট্রাস্টি মনোনীত করবার স্বাধীনতা গ্রহণ করেছি। আমার জীবনের এই ভাঙ্গা শেষ বয়সে এ জিনিসটা জানিতে পারিলাম যে, যে-প্রতিষ্ঠানের জন্য আমি আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ অংশ এবং শ্রেষ্ঠ সামর্থ্য নিয়োজিত করিয়াছি সেই প্রতিষ্ঠান আপনাকে তাহার একজন অভিভাবক রূপে লাভ করিবে।” চিঠির উত্তরে গান্ধী ট্রাস্টি মনোনয়নের পেছনে কোনভাবে আর্থিক প্রনোদনার বিষয়টি যুক্ত বলে ইঙ্গিত দিয়েছিলেন। বিষয়টি আবারও কবির মনঃক্ষুন্নের কারন হয়।

পরমতসহিষ্ণুতার প্রাপ্তি:
জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকান্ডের প্রতিবাদ স্বরূপ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘নাইটহুড’ উপাধি এবং মাহাত্মা গান্ধী ‘কাইজার-ই-হিন্দ’ পদ ফিরিয়ে দেন। দুটোই ছিল পরাধীন মানবাত্মার আহত বিবেকের মর্যাদাদীপ্ত সাহসী উদ্ভাসন। তদুপরি আদর্শিক এবং মৌলিক বিষয়ে তাঁদের মিল-অমিল ছিল যা তাঁরা নিজেরাই বুঝতে পেরেছিলেন। মতদ্বৈততায় তাঁরা ভিন্ন পথ অবলম্বন করেছেন কিন্তু পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধে তার প্রভাব পরতে দেননি। এ বিষয়ে কবি বলেছিলেন- “আমি নিজের সম্বন্ধে এ কথা স্বীকার করব যে মহাত্মার সঙ্গে সকল বিষয়ে আমার মতের ঐক্য নেই। অর্থাৎ আমি যদি তাঁর মতো চরিত্র প্রভাব-সম্পন্ন মানুষ হতেম তাহলে অন্যরকম প্রণালীতে কাজ করতুম। কী সে প্রণালী আমার অনেক পুরাতন লেখায় তার বিবরণ দিয়াছি। আমার মননশক্তি যদি বা থাকে কিন্তু আমার প্রভাব নেই। সেই প্রভাব আছে জগতে অল্প লোকেরই। দেশের সৌভাগ্যক্রমে দৈবাৎ যদি সে-রকম শক্তিসম্পন্ন পুরুষের আবির্ভাব হয় তবে তাঁকে তাঁর পথ ছেড়ে দিতেই হবে, তাঁর কর্মধারাকে বিক্ষিপ্ত করতে পারব না।”

১৯১৫ সালে গান্ধী ভারতে ফিরেই শান্তিনিকেতনে উঠেছিলেন এবং আশ্রমে বেশ কিছুদিন অবস্থানও করেছিলেন। শান্তিনিকেতনে গান্ধী পরিবার ও ছাত্রদের নিয়ে ওঠায় রবীন্দ্রনাথ আনন্দ প্রকাশ করে একটি চিঠি লেখেন, “আপনার ফিনিক্স স্কুলের ছাত্রগণ ভারতবর্ষে আসিয়া কোথায় আশ্রয় গ্রহণ করতে পারে সে প্রসঙ্গে যে আপনি আমার স্কুলকেই উপযুক্ত এবং সম্ভাবিত স্থান বলিয়া বিবেচনা করিয়াছেন, ইহা আমাকে সত্যকার আনন্দ দান করিয়াছে। … আপনি যে আপনার ছাত্রদের আমাদের ছাত্র হইয়া উঠিবার সুযোগ দিয়াছেন এবং এইভাবে আপনার ও আমার সাধনার মধ্যে একটা জীবন্ত যোগসূত্র গড়িয়া উঠিবার সুযোগ দিয়াছেন এজন্য আমি আপনাকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করিতেছি Ñ সেই ইচ্ছায়ই এই পত্র লিখিতেছি।” ১৯১৪ সালে আফ্রিকায় গান্ধীর ভক্ত ও কর্মিরা তাঁকে ‘মহাত্মা’ উপাধি দিলেও ভারতে বিশ্বকবিই প্রথম তাঁকে ‘মহাত্মা’ সম্বোধন করে ভারতবাসীকে তাঁর সমন্ধে সম্যক ধারণা দেন। গান্ধী প্রায় সাড়ে আট বছরের বড় রবীন্দ্রনাথকে ‘গুরুদেব’ বলে শুধু সম্বোধন করতেন না, সে ভাবেই শ্রদ্ধা করতেন। রবীন্দ্রনাথের বড় দাদা দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুরকে মহাত্মা গান্ধী ‘বড় দাদা’ ডাকতেন এবং আক্ষরিকভাবেই আত্মীয় মনে করতেন। অসহযোগ আন্দোলন নিয়ে রবীন্দ্রনাথের প্রকাশ্য সমালোচনা মহাত্মা গান্ধীর একান্ত অনুরাগী দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাল লাগতনা।

কবি গভীর শ্রদ্ধাবোধ থেকেই গান্ধীর প্রতিটি বিষয়ে অত্যন্ত সতর্ক দৃষ্টি রাখতেন। পুরো ভারতবর্ষের নেতৃত্ব দিতে গিয়ে গান্ধীর কথা ও আচরণের মধ্যে কখনও আপত্তিজনক কিছু লক্ষ্য করলে নিঃসঙ্কোচে তা ব্যক্তিগত চিঠির মাধ্যমে অথবা প্রকাশ্য বিবৃতির মধ্য দিয়ে গান্ধীর গোচরে আনবার চেষ্টা করতেন। কবিগুরুর সমালোচনা ছিল গান্ধীকে আরও সচেতন করার হাতিয়ার। সে কথা স্বীকার করে মহান প্রহরী প্রবন্ধে গান্ধী লেখেন, ‘যারা আমাদের সঙ্গে একমত নন, তাদের বিরুদ্ধে আমরা যারা অধৈর্য হয়ে অসহিষ্ণু, এমনকি হিংসাপরায়ণ হয়ে উঠি, তাদের জন্যে তাঁর (রবীন্দ্রনাথের) প্রবন্ধ এক যথার্থ সতর্কবাণী। আমি মনে করি, কবি আমাদের এমনই একজন প্রহরী, যিনি ধর্মীয় গোঁড়ামি, আলস্য, অসহিষ্ণুতা, অজ্ঞতা, জড়তা ও এই রকম আর সব শত্রুদের বিষয়ে সব সময় সাবধান করে দেন।’

১৯৩৪ সালের দিকে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে ভারতবর্ষে মহাত্মা গান্ধীর ব্যাপক সমালোচনা ও নিন্দা শুরু হলে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর দুঃখ ভারাক্রান্ত হৃদয়ে ৬/২/১৯৩৪ তারিখে সংবাদপত্রে একটি বিবৃতি দিলেন: “মহাত্মাজীই হইলেন একমাত্র লোক যিনি জনগণকে নৈরাশ্যের শোচনীয় অবস্থা এবং আত্ম-অপমানকর দাসত্বের গ্লানি হইতে জাগাইয়া তুলিতে সর্বাপেক্ষা বেশী উৎসাহিত করিয়াছেন। তাঁহার আশা ও বিশ্বাসের বাণী রাতারাতিই সমগ্র দৃষ্টিভঙ্গিকে পরিবর্তিত করিয়া দিয়াছে। যে-সব মানুষ শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরিয়া নিজেদের শিরে অপমানের বোঝাকে নিত্যকালের বলিয়া বিশ্বাস করিয়া আসিয়াছেÑ সেইসব মানুষের হৃদয়ে তিনি সাহস ও আত্মসম্মাান-বোধ জাগ্রত করিয়া দিয়াছেন। যিনি এই অলৌকিক ঘটনাকে সম্ভব করিয়া তুলিয়াছেন আমরা তাঁহার প্রতি সবিস্ময় শ্রদ্ধার্ঘ অর্পণ না করিয়া পারি না।”

মহাত্মা গান্ধী বিভিন্ন উপলক্ষ্যে বা ঘটনার প্রেক্ষিতে উপবাস/অনশন করতেন। এ সময় তিনি রবীন্দ্রনাথের আশীর্বাদ প্রার্থনা করতেন। নীতিগত ভাবে রবীন্দ্রনাথ উপবাস সমর্থন না করলেও গান্ধীর উপবাস রবীন্দ্রনাথকে ভিষণ উদ্বিগ্ন করত। তিনি আশীর্বাদ প্রেরণের পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট কর্তা-ব্যক্তিদের সাথে যোগাযোগ করতেন, চিঠি-পত্র লিখতেন। পত্রিকায় বিবৃতি দিতেন, আবেদন জানাতেন। শেষবারে তো নিজের অসুস্থ শরীর নিয়েই পুণা’র যারবেদা জেলে অনশনরত গান্ধীর পাশে গিয়ে উপস্থিত হন। ১৯৩৩ খ্রিস্টাব্দে মহাত্মা গান্ধী যখন অনশনের সঙ্কল্প গ্রহণ করেন তখন রবীন্দ্রনাথ দার্জিলিং থেকে পর পর দুটি চিঠি লেখেন। একটি ৯/৫/১৯৩৩ এবং অপরটি ১১/৫/১৯৩৩ তারিখে। চিঠি দুটিতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ঠিক অভিভাবকের মত করে পথ নির্দেশনা দিয়েছেন।

রবীন্দ্রনাথের চিঠিগুলিতে ষ্পষ্টতই উল্লেখ ছিল যে, পারিপার্শ্বিক চাপ, হতাশা কিংবা ব্যর্থতায় উপবাসের মধ্য দিয়ে আত্ম-বিসর্জনের পরিবর্তে স্বীয় আদর্শে বলীয়ান হয়ে বাঁধা-বিপত্তিকে পিছনে ফেলে এগিয়ে যাওয়াই বীরের ধর্ম। অবসাদগ্রস্ত হয়ে মর্মবেদনায় নিজের অবস্থান ত্যাগ করে দূরে চলে যাওয়া আত্মঘাতি সিদ্ধান্ত। উপবাসের শারিরিক এবং মানসিক উদ্দীপনা তৈরির গুরুত্বকে কবি স্বীকার করলেও আত্ম-বিসর্জনের সঙ্কল্পকে সাধু সঙ্কল্প বলে মনে করতেন না। গান্ধী এ ক্ষেত্রে উত্তর দিতেন, হতাশা এবং বিরক্তি আছে তবে আত্মঘাতি হওয়ার ইচ্ছাতে তাঁর উপবাস নয়। উপবাস ছিল মহাত্মারকাছে আত্ম-বিশুদ্ধির ভিতর দিয়ে অজেয় অধ্যাত্ম-শক্তিলাভের প্রকৃষ্টতম উপায়।

মহাত্মা গান্ধী এবং রবীন্দ্রনাথ দুজনের মধ্যে মিলনের দূতিয়াল, ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের একনিষ্ঠ সেবক, শিক্ষাবিদ ও সমাজ সংস্কারক দীনবন্ধু চার্লস ফ্রিয়ার এন্ড্রুজ ১৯৪০ সালের ৫ এপ্রিল মৃত্যুবরণ করেন। মহামতি এন্ড্রুজের মৃত্যুও পর ব্যথিত হৃদয়ে গান্ধী ও রবীন্দ্রনাথ পত্র মারফত পরস্পরের মর্মবেদনা ভাগাভাগি বরেছেন। এই মহাপ্রাণ মানব-প্রেমিকের উপযুক্ত স্মৃতি রক্ষা করার বিষয়েও মতামত প্রকাশ করেু চিঠি বিনিময় করেছেন।

১৯৩৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসে রবীন্দ্রনাথ হঠাৎ অজ্ঞান হয়ে পড়লে উদ্বিগ্ন গান্ধী প্রীতিপূর্ণ বার্তা পাঠালেন। বার্তাটি কবিকে পুলকিত করেছিল। এর পরই কবি কিছুটা সুস্থ হয়েই ১৯/৯/১৯৩৭ সালে গান্ধীকে চিঠি লিখলেনÑ ’যে সংজ্ঞাহীন কাল আমাকে কাটাইতে হইয়াছে তাহার পরে যে জিনিসটি আমাকে প্রাণের জগতে প্রথম সম্বর্ধনা জানাইয়াছে তাহা হইল আপনার ¯েœহময় দুশ্চিন্তার বার্তাটি; যে দীর্ঘস্থায়ী অবিরাম কষ্টভোগের মূল্যে এই বার্তা আমি লাভ করিয়াছি এই বার্তা সেই মূল্যের যোগ্য বলিয়া মনে করি।’ ১৯৪০ এর ১৭ ফেব্রুয়ারি রবীন্দ্রনাথের সাথে গান্ধীর শেষ দেখা হয়েছিল শান্তিনিকেতনে।

আ¤্রকুঞ্জে কবি গান্ধীকে সম্বর্ধনা জানিয়ে ভাষণে বললেনÑ ‘বর্তমান মুহূর্তে অনেক সমস্যা আছে, আমরাও কেহ এইগুলির আক্রমণ থেকে মুক্ত নহি। একটি মুহূর্তের জন্য আজ আমরা এই সকল কল-কোলাহলের এবং ধুলার আঁধির উর্দ্ধে উঠিতে চাই এবং আজিকালের অস্থির রাজনৈতিক আবর্ত হইতে উত্থিত হইয়া সকল রাজনৈতিক গোলযোগ যখন শান্ত হইয়া যাইবে এবং আমাদের সকল সাধনার শাশ্বত মূল্য যেদিন প্রকাশিত হইবেÑ আজিকার দিনের মিলনের এই স্মৃতি সেদিন জাগ্রত থাকিবে।” ১৯৪০ এর সেপ্টেম্বর মাসে কালিম্পঙ সফরে রবীন্দ্রনাথ গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লে তাঁকে কলকাতায় আনা হয়। ১/১০/১৯৪০ তারিখে গান্ধী কবিকে লিখলেনÑ“আপনার আরও কিছুদিন থাকিতে হইবে। মানুষের আপনাকে প্রয়োজন। আপনি ভাল আছেন জানিয়া আমি অপরিসীম আনন্দ লাভ করিয়াছি।

” এর উত্তরে কবি লিখলেনÑ“আপনার নিরন্তর শুভেচ্ছা আমাকে অন্ধকারের দেশ হইতে আবার আলোক এবং জীবনের দেশে ফিরাইয়া আনিয়াছে, আমার ধন্যবাদের প্রথম অর্ঘ্য আপনার প্রতি।” একটু সুস্থ হয়ে কবি গান্ধীকে একটি গান লিখে পাঠান ১৯৪১ এর ১ ডিসেম্বর। গান্ধী ১৯৪১ সালের ১৩ এপ্রিল রবীন্দ্রনাথকে টেলিগ্রাম যোগে জন্মদিনের শুভেচ্ছা পাঠানÑ“চারকুড়ি যথেষ্ট নয়, পাঁচকুড়ি যেন শেষ করিতে পারেন। ভালোবাসা।” রবীন্দ্রনাথ তার উত্তরে লিখলেনÑ“আপনার বাণীর জন্য ধন্যবাদ; কিন্তু চারকুড়িই ধৃষ্টতা, পাঁচকুড়ি অসহ্য।”

১৯৪১ এর ৭ আগস্ট কবির মৃত্যু সংবাদ পেয়ে গান্ধী কবি পুত্র রথাীন্দ্রনাথকে টেলিগ্রাম পাঠানÑ“তুমি যাহা হারাইলে আমিও তাহাই হারাইলামÑনা সমগ্র জাতিÑজাতি কেন, সমস্ত জগৎ তাহা হারাইল। গুরুদেব একটি প্রতিষ্ঠানের রূপ গ্রহণ করিয়াছেন, আমরা আমাদের কর্মের দ্বারা যেন গুরুদেবের উপযুক্ত উত্তরসাধক হইয়া উঠিতে পারি।” রবীন্দ্রনাথের ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চল রে’ গানটি শেষ বয়সে গান্ধী প্রায় দৈনন্দিন জাপ্য মন্ত্ররূপেই গ্রহণ করেছিলেন। এছাড়া রবীন্দ্রনাথের লেখা আর একটি গান ‘জীবন যখন শুকায়ে যায় করুণা ধারায় এসো’ গান্ধীর ক্ষুব্ধ শ্রান্ত মনে সর্বদাই অনুপ্রেরণা যোগাতো।

পরিশিষ্ট:
সাহিত্যে নোবেল বিজয়ী এবং উনবিংশ শতাব্দীতে বিশ্বের প্রখ্যাত প্রগতিশীল চিন্তাবিদ ও সাহিত্যিকদের মধ্যে অন্যতম ফরাসি মনীষী রম্যাঁ রলাঁ গান্ধীকে নিয়ে একটি পুস্তিকা রচনা করেছিলেন। একাধারে সঙ্গীতজ্ঞ, বিশ্বশান্তির প্রবক্তা ও শিক্ষাবিদ রম্যাঁ রলাঁ ছিলেন প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য চিন্তা জগতের সেতু বন্ধনকারী। রবীন্দ্রনাথের দৃষ্টিতে রলাঁ ছিলেন পাশ্চাত্যে ভারতের ‘আধ্যাত্মিক’ দূত। ২ মার্চ, ১৯২৩ তাঁর তরুণ বন্ধু রবীন্দ্রানুরাগী কালিদাস নাগকে চিঠিতে লিখেছিলেন: “আমি আমার ‘গান্ধী’ শেষ করেছি, যেখানে আমি তোমাদের নদীর মতো ঐশ্বরিক চিন্তায় পল্লবিত দুই মহৎ আত্মার প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়েছি, ঠাকুর ও গান্ধী।” রবীন্দ্রনাথকে তিনি একই তারিখের চিঠিতে জানিয়েছেন: “গান্ধীর সব কথার সঙ্গে একমত না হয়েও তাঁর ব্যক্তিত্বের প্রতি এক অসীম ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা আমার হৃদয়ে জেগেছে, কারণ তাঁর মহৎ হৃদয়ে ভালোবাসা সততই প্রজ্জ্বলিত।” নিজের ডায়েরিতে তিনি লিখেছেন, “এন্ড্রুজ আমার সঙ্গে একমত হয়েছেন আমার এই তুলনায় যে গান্ধী হলেন সেন্ট পল আর রবীন্দ্রনাথ প্লেটো।” অন্য এক জায়গায় তিনি গান্ধীকে সেন্ট ফ্রান্সিস আসিসি’র সঙ্গে তুলনা করেছেন।

রলাঁ গান্ধী ও রবীন্দ্রনাথের ভাবনার স্বাতন্ত্র্য সম্পর্কে অবহিত ছিলেন, কোনও কোনও সময় তিনি কবির ভাবনার সঙ্গেই সায় দিয়েছেন তাঁর আন্তর্জাতিকতার জন্য, কিন্তু তবু গান্ধীর প্রতি তাঁর শ্রদ্ধা কমেনি। ১৯২৫-এ কালিদাস নাগের চিঠিতে গান্ধী সম্পর্কে বিরূপ মন্তব্য লক্ষ্য করে রলাঁ তাঁকে লিখছেন: “গান্ধী ও তাঁর রাজনীতিতে অংশগ্রহণ বিষয়ে এত রূঢ় হোয়ো না। সবার ভূমিকা এক নয়, ঠাকুর ও গান্ধীর মতো মহৎ আত্মার প্রত্যেকের আলাদা স্থান আছে; এঁরা প্রত্যেকেই আমাদের মানবিক ঐতিহ্যের মূল বিষয়গুলোকে রক্ষা করছেন। হিংসা যেভাবে সৃষ্টি হচ্ছে, সব সীমা ভেঙে দেবার ভয় দেখাচ্ছে, সেখানে গান্ধী যদি হিংসা আটকাতে পারেন বা অন্তত বিশ বছর তাকে পিছিয়ে দিতে পারেন, ভারত ও বিশ্বের কাছে তার অমূল্য উপকার হবে। নিজেকে রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত করে তিনি রাজনীতিকে মানবিক করে তুলবেন, শুধু তা-ই নয়,আমি বরং বলব, তিনি রাজনীতিকে ঐশ্বরিক করবেন।”

ব্যক্তিগত, জাতীয়, আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বিভিন্ন বিষয়ের কর্মপরিকল্পনা ও প্রয়োগ পদ্ধতি নিয়ে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে গান্ধীর মতপার্থক্য ছিল দিবালোকের মত স্পষ্ট। রলাঁ মনে করতেন, ঠাকুরের লক্ষ্য উঁচু স্তরের, সুদূরপ্রসারী; তাঁর লক্ষ্য সব শ্রেণি জাতি ও শতাব্দী পেরিয়ে মানবাত্মার উত্তরণ। গান্ধীর লক্ষ্য একটা যুগ ও একটা জাতির প্রয়োজন অনুসারে নির্দিষ্ট। একজন কবি এবং একজন কর্মির মধ্যকার মানবিক পার্থক্যকে উভয়ে অতিক্রম করতে পারলেও থিতু ছিলেন ব্যক্তিসত্ত্বায়, আদর্শ এবং মৌলিকতায়। ব্যক্তি জীবনের লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্যের প্রতি তারা সবসময়ই ছিলেন নিষ্ঠাবান ও সচেষ্ট। মূলত এই লক্ষ্যই তাদের সকল মতপার্থক্য গড়ে দিয়েছে।

তবে মতবিরোধকে মুক্তকণ্ঠে প্রকাশ উভয়ের শ্রদ্ধানুরক্তিকে আরও দৃঢ় করে দিয়েছে; সম্পর্ককে ভেতর থেকে মজবুত করেছে। গান্ধীকে স্বদেশ মুক্তির ধ্যানে মগ্ন রাখতে রবীন্দ্রনাথ গান্ধী বিদ্বেষীদের অহেতুক নিন্দার কড়া প্রতিবাদ করেছেন পাশাপাশি গান্ধীর নানান সিদ্ধান্তের তীব্র সমালোচনা করে অলক্ষিত পারিপাশির্^ক বিষয় সমন্ধে নিয়মিত সচেতন করেছেন। গান্ধীও রবীন্দ্রনাথের সমালোচনার প্রসংশা করে সশ্রদ্ধ জবাব দিয়েছেন, বিভিন্ন বিষয়ে যুক্তি দিয়ে নিজের অবস্থান পরিষ্কার করেছেন, মতামত ভাগাভাগি করেছেন অথবা সহমত পোষন করেছেন। রবীন্দ্রনাথের গঠনমূলক সমালোচনা গান্ধীকে যুগিয়েছিল নানামূখী ভাবনার খোরাক যা তাঁর কর্মপরিকল্পনাকে আরো নিখুঁত ও কার্যকর করতে উদ্বুদ্ধ করেছে। এমন পরমতসহিষ্ণু মনোভাবে এই দুই মহৎ হৃদয় যে কেবল ব্যাপক প্রসংশিত ও সম্মানিত হয়েছেন, জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে শ্রদ্ধার পাত্র হিসেবে কালজয়ীই হয়েছেন বিষয়টি শুধু তা নয়। তাদের এই মতপার্থক্য বিভিন্ন ভাবে ভারতবর্ষের স্বাধীনতা ও সমাজ সংস্কারের কার্যক্রমকে আরো গতিশীল করেছে। মতপার্থক্য ও বিরোধে পরমতসহিষ্ণুতার এমন উদাহরণ আমাদের জন্য শিক্ষাস্বরূপ।

লেখক:
কলামিস্ট, সাহিত্যিক ও গবেষক

hmahaque.ju@gmail.com

সহায়ক পাঠ :
১.The Philosophy of Rabindranath Tagore– Kalyan Sen Gupta

২. ‘হিন্দ স্বরাজ’ ও গান্ধীর শিল্পভাবনা- দেবোত্তম চক্রবর্তী
৩. ‘গুরুদেব’ রবীন্দ্রনাথ ও ‘মহাত্মা’ গান্ধী- হাবিবুর রহমান স্বপন
৪. রবীন্দ্রনাথ, গান্ধী ও অসহযোগের রাজনীতি- সনৎকুমার সাহা
৫. রবীন্দ্রনাথ ও মহাত্মা গান্ধী: অনৈক্যের মধ্যে ঐক্য- সৈয়দ কওসর জামাল
৬. রবীন্দ্র আলোয় গান্ধীজী, গান্ধী আলোয় রবীন্দ্রনাথ- সুপ্রিয় মুন্সি
৭. রবীন্দ্রনাথ ও জাতীয়তাবাদ- অধ্যাপিকা সঞ্চিতা দত্ত
৮. মহাত্মা গান্ধী ও বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ- তপন চক্রবর্তী
৯. K. Gandhi – CWMG Vol. 24 & 29-Publication Division, N. Delhi, 1983.

১০. গুরুদেব এবং মহাত্মা যখন বিপরীত মেরুতে- বৈজয়ন্ত চক্রবর্তী
১১. মহাত্মা গান্ধী স্মরণে- হীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়
১২. মহাত্মা- সুনীল সেন
১৩. গুরুদেবের কাছে মহাত্মা- মাধব ভট্টাচার্য
১৪. রবিজীবনী- প্রশান্তকুমার পাল
১৫.Gandhiji on KHADI– Divya Joshiy

১৬. রবীন্দ্রজীবনী- প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়
১৭. পশ্চিমবঙ্গ: গাঁধীসংখ্যা, জানু-ফেব্রু ১৯৯৫

তথ্যটি গুরুত্বপূর্ণ মনে হলে শেয়ার করুন

More News Of This Category