1. mahfujpanjeree@gmail.com : Mahfuzur-Rahman :
  2. admin@samagrabangla.com : main-admin :
  3. mahmudursir@gmail.com : samagra :

মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস (১২০১-১৮০০)

  • Update Time : বুধবার, জানুয়ারি ২০, ২০২১

অন্ধকার যুগ (১২০১-১৩৫০):

বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে ১২০১ থেকে ১৮০০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত মধ্যযুগ। প্রথম ১৫০ বছর অন্ধকার যুগ; সাহিত্যের কোনো উল্লেখযোগ্য নিদর্শন না পাওয়ায় ঐতিহাসিকগণ এ সময়কে বাংলা সাহিত্যের ‘অন্ধকার যুগ’ হিসেবে চিহ্নিত করে থাকেন।

রামাই পণ্ডিত রচিত ‘শুণ্যপুরাণ’ গদ্য-পদ্য মিশ্রিত চম্পুকাব্য। ‘নিরঞ্জনের উষ্মা’ শুন্যপুরাণ কাব্যের একটি বিখ্যাত কবিতা। কবিতাটি ত্রয়োদশ শতকের শেষের দিকে রচিত।
হলায়ুধ মিশ্র রচিত সংস্কৃত গদ্যপদ্যে রচিত চস্পুকাব্য ‘সেক শুভোদয়া’। ‘সেক শুভোদয়ায়’ রাজা লক্ষèণ সেন ও শেখ জালানুদ্দীন তাবরেজির অলৌকিক কাহিনী বর্ণিত হয়েছে। হলায়ুধ মিশ্র রাজা ল²ণ সেনের সভাকবি ছিলেন।

মধ্যযুগের কাব্যধারা চারটি ধারায় প্রবাহিত:
(১) মঙ্গল কাব্য (২) অনুবাদ সাহিত্য
(৩) রোমান্টিক প্রণয়োপাখ্যান ও (৪) বৈষ্ণব পদাবলী।

• মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের শাখা-প্রশাখাগুলো হচ্ছে-
(ক) শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্য (খ) মঙ্গলকাব্য
(গ) অনুবাদ সাহিত্য (ঘ) বৈষ্ণব পদাবলী
(ঙ) জীবনী সাহিত্য (চ) নাথ সাহিত্য
(ছ) মর্সিয়া সাহিত্য (জ) দোভাষী পুঁথি
(ঝ) রোমান্টিক প্রণয়োপাখ্যান ও (ঞ) লোক সাহিত্য।

শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্য:

‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ কাব্য মধ্যযুগের প্রথম কাব্য। এ কাব্যের রচয়িতা বড় চণ্ডীদাস। ভাবগত পুরাণের কৃষ্ণলীলা সম্পর্কিত কাহিনী অবলম্বনে লোকসমাজে প্রচলিত রাধাকৃষ্ণের প্রেমকাহিনীকে অবলম্বন করে শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যের কাহিনী গড়ে উঠেছে। বসন্তরঞ্জন রায় বিদ্বদ্বল্লভ ১৯০৯ খ্রিষ্টাব্দে (বাংলা ১৩১৬) পশ্চিমবঙ্গের বাঁকুড়া জেলার কাঁকিল্যা গ্রামের মল্লরাজ গুরু বৈষ্ণব মহন্ত শ্রীনিবাস আচার্যের দৌহিত্র বংশজাত শ্রী দেবেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের বাড়ির গোয়ালঘর থেকে শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যের পুঁথি আবিস্কার করেন। ১৯১৬ খ্রিষ্টাব্দে বসন্তরঞ্জন রায়ের সম্পাদনায় ‘বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ’ থেকে শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্য গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়। শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যের প্রকৃত নাম ‘শ্রীকৃষ্ণসন্দর্ভ।

বসন্তরঞ্জন রায়ের উপাধি ছিল ‘বিদ্বদ্বল্লভ’। শ্রীকৃষ্ণকীর্তন নামটি প্রদান করেন সম্পাদক বসন্তরঞ্জন রায়। শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যের কবি বড় চণ্ডীদাস। রচনাকালের দিক থেকে বাংলা সাহিত্যের দ্বিতীয় গ্রন্থ হল শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্য। এর রচনাকাল চতুর্দশ শতক। এটি নাট-গীত (গীতি-নাট্য) ভঙ্গিতে তের খণ্ডে রচিত। সমস্ত কাব্যে মোট তিনটি চরিত্র আছে- রাধা, কৃষ্ণ ও বড়ায়ি। কাব্যটির বিষয়বস্তু হল রাধা ও কৃষ্ণের প্রেমলীলা। মর্তবাসী রাধা ও কৃষ্ণের প্রকৃত পরিচয় বিষ্ণুপ্রিয়া লক্ষীদেবী ও বিষ্ণু। কৃষ্ণ ও রাধার আকর্ষণীয় প্রণয়কাহিনী সম্বলিত শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যে নরনারীর প্রণয় সম্পর্কের ওপরে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। তৎকালীন সমাজের বাস্তব চিত্রও এতে ফুটে ওঠেছে। শ্রীকৃষ্ণকীর্তন দেহবাদী রগরগে প্রেমের কাহিনী। এ কাব্যে প্রথমে যে রাধাকে দেখানো হয় তিনি প্রেমের তাৎপর্য বুঝেন না। বড়ায়ির সহায়তায় নানা ছল করে কৃষ্ণ কীভাবে রাধার সাথে দৈহিক মিলনের স্বাদ নিলেন এ কাব্যে তা বিশদ বর্ণিত হয়েছে। মিলনের পর কৃষ্ণ রাধার প্রতি আকর্ষণ হারিয়ে ফেলে এবং কাজের ছুতায় অন্যত্র গমন করে। রাধার চরম বিরহের মধ্য দিয়ে এ কাব্যের পরিসমাপ্তি। রাধার তীব্র বিরহ এ কাব্যে দরদের সাথে অঙ্কিত হয়েছে।
মধ্যযুগে পুঁথিগুলো নকল হওয়ার সময় ভাষার পরিবর্তন ঘটলেও শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যে পুরানো বাংলার লক্ষণ রয়ে গেছে। ধারণা করা হয়, এ কাব্য জনপ্রিয়তা হারিয়ে ফেলেছিল এবং লোকমুখে জনপ্রিয় ছিল না। বড়ু চÐীদাস এ কাব্য রচনা করেছিলেন চৈতন্যদেবের আগে। চৈতন্যদেব বৈষ্ণব দর্শনের নতুন ব্যাখ্যা দেয়ার পর শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের দেহবাদী কাহিনী আর জনপ্রিয়তা ধরে রাখতে পারে নি। ফলে এ কাব্য বন্দী হয় পুঁথির পাতায়।

• ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহের মতে চণ্ডীদাস তিন জন-
(১) বড়ু চণ্ডীদাস; (২) দ্বিজ চণ্ডীদাস ও (৩) দীন চণ্ডীদাস।
বড় চণ্ডীদাস চৈতন্য পূর্ববর্তী যুগের, দ্বিজ চণ্ডীদাস চৈতন্য যুগের এবং দীন চণ্ডীদাস চৈতন্য পরবর্তী যুগের কবি। শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের বড় চণ্ডীদাস বাসুলী দেবীর ভক্ত।
শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের একটি লাইন-
‘কে না বাঁশী বা এ বড়ায়ি কালিনী নইকুলে’

মঙ্গল কাব্য:
মঙ্গল কাব্য- ধর্মবিষয়ক আখ্যান কাব্য নামে খ্যাত। খ্রিষ্টীয় পঞ্চদশ শতাব্দী থেকে অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ পর্যন্ত এসব মঙ্গল কাব্য রচিত হয়েছে। অনেকের মতে এক মঙ্গলবার থেকে পরবর্তী মঙ্গলবার পর্যন্ত পালাকারে গতি হতো বলে এর নাম মঙ্গলকাব্য। মঙ্গলকাব্যের প্রধান দুই দেবী হচ্ছেন মনসা ও চণ্ডী।
মঙ্গলকাব্যগুলো গীত হতো পূজানুষ্ঠানের অঙ্গ হিসাবে। প্রতিটি কাব্য নির্দিষ্ট সংখ্যক পালায় বিভক্ত- মনসামঙ্গল ৩০ পালায়, চণ্ডীমঙ্গল ১৬ পালায়।
মঙ্গলকাব্য দু’ শ্রেণিতে বিভক্ত-
(১) পৌরাণিক মঙ্গলকাব্য;
(২) লৌকিক মঙ্গলকাব্য। লৌকিক মঙ্গলকাব্যে বণিক ও নিন্মবর্ণেও মানুষের প্রাধান্য দেখা যায়।
মঙ্গলকাব্যের প্রথম যুগের ভাষা স্থল ও গ্রাম্যতাপূর্ণ, মধ্যযুগের ভাষা সহজ ও সাবলীল এবং শেষ যুগের ভাষা অলঙ্কারসমৃদ্ধ।

মনসামঙ্গল কাব্য:

সর্পসংকুল ভারতবর্ষে নানা মূর্তিতে সাপের পূজা হয়- উত্তর ভারতে সরীসৃপ মূর্তির, দক্ষিণ ভারতে জীবিত সর্পের পূজা হয়। পূর্বভারতে তথা বঙ্গদেশে মনসার ঘটের পূজা করা হয়। উত্তর ভারতে সাপের দেবতা বাসুকী পুরুষ বঙ্গদেশে মনসা নারী। মনসামঙ্গল কাব্য মঙ্গল কাব্যের ইতিহাসে সবচেয়ে প্রাচীন মঙ্গলকাব্য। মনসামঙ্গল কাব্যের নাম চরিত্র লৌকিক দেবী-সর্পদেবী মনসা। মনসা দেবীর অন্য নাম- কেতকা ও পদ্মাবতী। মনসামঙ্গল কাব্যের প্রধান প্রধান চরিত্র- দেবী মনসা, চাঁদ সওদাগর, সনকা, বেহুলা ও লখিন্দর।

মনসামঙ্গল কাব্যের কবি:
•মনসামঙ্গল কাব্যের আদি কবি কানা হরিদত্ত। তার পুঁথি পাওয়া যায় নি। বিজয়গুপ্ত হরিদত্তকে মূর্খ ও ছন্দোজ্ঞানহীন বলে উল্লেখ করেছেন। তবে মনসা কাহিনীর যে কাঠামো তিনি সৃষ্টি করেছেন তা কয়েক শত বছর ধরে অনুসৃত হয়েছে, এটি তার মৌলিকতার পরিচয়।
• সুস্পষ্ট সন তারিখযুক্ত মনসামঙ্গল কাব্যের প্রথম রচয়িতা কবি বিজয়গুপ্ত। তার কাব্যের নাম পদ্মপুরাণ। কবি বিজয়গুপ্ত বরিশাল জেলার গৈলা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। গৈলা গ্রামের প্রাচীন নাম ফুল্লশ্রী। কবি বিজয়গুপ্ত সুলতান আলাউদ্দিন হুসেন শাহের শাসনামলে ১৫৯৪ খ্রিষ্টাব্দে কাব্য রচনায় প্রবৃত্ত হন। তার কাব্যের ব্যপক প্রচার হয়েছিল।
মনসামঙ্গল কাব্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি নারায়ণদেব। বর্তমান কিশোরগঞ্জ জেলার বোরগ্রামে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। নারায়ণ দেব পঞ্চদশ শতকের শেষ ভাগের কবি। তার কাব্যের নাম ‘পদ্মপুরাণ’ পদ্মপুরাণের একটি চরণ- “সিবলিঙ্গ আমি পূঁজি জেই হাতে সেই হাতে তোমারে পূজিতে না লয় চিত্তে”।
• কবি বিপ্রদাস পিপিলাই ১৪৯৫ সালে ‘মনসাবিজয়’ কাব্য রচনা করেন। চব্বিশ পরগণা জেলার নদুড়্যা চট্টগ্রাম (পাঠান্তরে বাদুড্যা) ছিল বিপ্রদাসের নিবাস। তার পিতা মুকুন্দ পণ্ডিত।
• বিজয় বংশীদাস রচিত মঙ্গলকাব্যের নাম ‘পদ্মপুরাণ’। তিনি কিশোরগঞ্জ জেলার পাতুয়ারী গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। দ্বিজ বংশীদাস কবি চন্দ্রাবতীর পিতা। চন্দ্রাবতী বাংলা সাহিত্যের প্রথম মহিলা কবি। কবি দ্বিজ বংশীদাস সুকণ্ঠ গায়ক হিসেবেও খ্যাত ছিলেন। তিনি বিভিন্ন শাস্ত্রে পণ্ডিত ছিলেন এবং বাড়িতে টোল চালাতেন।

• আরেক জনপ্রিয় কবি কেতকাদাস ক্ষেমানন্দ পশ্চিমবঙ্গের কবি। জনপ্রিয়তায় শ্রেষ্ঠ কবি কেতকাদাস ক্ষেমানন্দ-এর মূল নাম ক্ষেমানন্দ এবং কেতকাদাস তার উপাধি। কেতকা দেবী মনসার অপর নাম। কবি কেতকাদাস ক্ষেমানন্দ দেবীকর্তৃক আদিষ্ট হয়ে কাব্য রচনা করেছেন। কবি ক্ষেমানন্দের কাব্যে মুকুন্দরাম চক্রবর্তীর চণ্ডীমঙ্গল ও রামায়ণ কাহিনীর প্রভাব রয়েছে।
• দেবনাগরী অক্ষরে ও আঞ্চলিক শব্দে লিখিত আর ও একটি পুঁথি আবিস্কৃত হয়েছে যার রচয়িতা ক্ষেমানন্দ নামে আরেক স্বতন্ত্র কবি।

• বাইশা: বাইশা কবির পদসংকলন বা ‘বাইশ কবির মনসামঙ্গল’ বা বাইশ কবির মনসা বা বাইশা নামে খ্যাত।
• মধ্যযুগের সবচেয়ে প্রতিবাদী চাঁদ সওদাগর। চাঁদ সওদাগরের স্ত্রীর নাম সনকা। চাঁদ সওদাগরের চৌদ্দ ডিঙ্গা মনসা ডুবিয়ে দিয়েছিল এবং ছয় পুত্রকে মেরে ফেলেছিল।
• বেহুলা স্বর্গের দেবতাদের নামে গানে সন্তুষ্ট করলে মৃত স্বামী লখিন্দরের জীবন ফিরে পায়। চাঁদ সওদাগর অন্যদিকে ফিরে বাম হাতে মনসার মূর্তিতে ফুল ছুড়ে দিলে পৃথিবীতে মনসার পূজা প্রচলিত হয়।

চণ্ডীমঙ্গল কাব্য:

চণ্ডীদেবীর কাহিনী অবলম্বনে রচিত কাব্য চণ্ডীমঙ্গল কাব্য। চণ্ডীমঙ্গলকাব্য দুখণ্ডে বিভক্ত- (ক) আক্ষেটিক খণ্ড; (খ) বণিক খণ্ড। আক্ষেটিক খণ্ডে বর্ণিত অংশের নাম কালকেতু উপাখ্যান। দ্বিতীয়খণ্ডে বণিকখণ্ডে বর্ণিত হয়েছে ধনপতি সওদাগরের কাহিনী।
কালকেতু উপাখ্যানে দেবী চণ্ডী স্বর্ণগোধিকার ছদ্মবেশ ধারণ করেন। কালকেতু স্বর্ণগোধিকাকে শিকার করে ঘরে নিয়ে গেলে কালকেতুর ঘরে গিয়ে দেবী নিজ রূপ ধারণ করেন। কালকেতুকে সাত ঘড়া ধন দিয়ে পূঁজা প্রচারের নির্দেশ দেন। দেবীর নির্দেশে কালকেতু গুজরাটে বন কেটে নগর পত্তন করে। কালকেতু উপাখ্যানে বৌচণ্ডী স্বর্ণগোধিকার ছদ্মবেশ ধারণ করেন। কালকেতু স্বর্ণগোধিকাকে শিকার করে ঘরে নিয়ে গেলে কালকেতুর গরে গিয়ে দেবী নিজ রূপ ধারণ করেন। কালকেতুকে সাত ঘড়া ধন দিয়ে পূজা প্রচারের নির্দেশ দেন। দেবীর নির্দেশ কালকেতু গুজরাটে বন কেটে নগর পত্তন করে। কালকেতু মর্ত্যে আসার পূর্বে স্বর্গরাজ্যের দেবতা ইন্দ্রের পুত্র ছিল এবং তার নাম ছিল নীলাম্বর। ফুল্লরা ছিল নীলাম্বর পত্নী, স্বর্গরাজ্যের নাম ছিল ছায়া। অভিশপ্ত হয়ে নীলাম্বর ও ছায়া মর্ত্যে ব্রাধের ঘরে জন্ম নেয়। ধনপতি সদাগরের কাহিনীর প্রধান চরিত্র ধনপতি সওদাগর, লহনা, খুল্লনা, দেবীচণ্ডী, সিংহল রাজ, শ্রীমন্ত।

চণ্ডীমঙ্গল কাব্যের কবি:
•চণ্ডীমঙ্গল কাব্যের আদি কবি মানিক দত্ত। মানিক দত্ত গৌড় বা মালদহ অঞ্চলের লোক ছিলেন। তিনি কানা ও খোঁড়া ছিলেন। দেবী চণ্ডীর দয়ায় তিনি সুস্থ হন এবং স্বপ্নাদিষ্ট হয়ে কাব্য রচনা করেন।

• দ্বিজ মাধব চণ্ডীমঙ্গল কাব্যের অন্যতম কবি। তার কাব্যের নাম সারদামঙ্গল। সারদামঙ্গল কাব্য ১৫৭৯ খ্রিষ্টাব্দে রচিত। তার কাব্যে চণ্ডীর নাম ‘মঙ্গলচণ্ডী’। ‘মঙ্গল’ নামে অসুর বধ করে দেবী এই নামে পরিচিত হয়েছেন। তিনি কৃষ্ণমঙ্গল ও গঙ্গামঙ্গ নামে আরো দুটি কাব্য রচনা করেন।
• চণ্ডীমঙ্গল কাব্যের সর্বশ্রেষ্ঠ কবি মুকুন্দরাম চক্রবর্তী। মুকুন্দরাম চক্রবর্তীর উপাধি হল কবিকঙ্কন। মুকুন্দরাম চক্রবর্তী ষোড়শ শতকে বর্ধমান জেলার রত্মা নদীর কূলে দামুন্যা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ডিহিদার মাহমুদ শরীফের অত্যাচারের কারণে তিনি দামুন্যা ত্যাগ করে ব্রাহ্মণভূমির রাজা বাকুড়া রায়ের অড়রা গ্রামে আশ্রয় গ্রহণ করেন এবং তার ছেলে রঘুনাথের শিক্ষক নিযুক্ত হন। বাঁকুড়া রায়ের মৃত্যুর পর রঘুনাথ জমিদার হলে রঘুনাথে পৃষ্ঠপোষকতায় কবি মুকুন্দরাম ‘শ্রী শ্রী চণ্ডীমঙ্গল কাব্য’ রচনা করেন। জমিদার রঘুনাথ রায় কবি প্রতিভার স্বীকৃতিস্বরূপ কবি মুকুন্দরামকে ‘কবিকঙ্কন’ উপাধি দেন। তবে সুকুমার সেন একে স্বয়ংগৃহীত বলে মনে করেন। মুকুন্দরাম রচিত কাব্যের না ‘চণ্ডীমঙ্গল’; এছাড়া অনেক ক্ষেত্রে ‘অভয়মঙ্গল’, ‘আম্বিকামঙ্গল’, ‘গৌরীমঙ্গল’, ‘চণ্ডীকামঙ্গল’ নামও পাওয়া যায়। মুকুন্দরাম রচিত চণ্ডীমঙ্গল তিনখণ্ডে বিভক্ত-

(১) দেবখণ্ড-সতী ও পার্বতীর কাহিনী;
(২) আক্ষেটিক খণ্ড-কালকেতুর কাহিনী ও
(৩) বণিক খণ্ড- ধনপতি সদাগরের কাহিনী।

•চণ্ডীমঙ্গলের আরে কবি দ্বিজ রামদেব। তার কাব্যের নাম ‘অভয়ামঙ্গল’ কাব্য।

•চণ্ডীমঙ্গল কাব্যের আরও একজন কবি মুক্তারাম সেন। মুক্তারাম সেন চট্টগ্রাম জেলার দেবগ্রামে (বর্তমানে আনোয়ারায়) জন্মগ্রহণ করেন।

• দেবরাম সেন রচিত কাব্যের নাম ‘সারদামঙ্গল’।
• সপ্তদশ শতকের শেষ ভাগে কবি হরিরাম ‘চণ্ডীমঙ্গল কাব্য’ রচনা করেন।
• কবি লালা জয়নারায়ণ সেন চণ্ডীমঙ্গলের আরেক কবি। তিনি মুন্সীগঞ্জ জেলার বিক্রমপুরের জপসা অধিবাসী ছিলেন। কবি লালা জয়নারায়ণ সেন এর কাব্যের নাম “হরিলীলা”।
• কবি ভবানীশঙ্কের দাস ১৭৭৯ খ্রিষ্টাব্দে মঙ্গলচণ্ডী পাঞ্চলিক রচনা। তার কাব্য জাগরণের পুঁথি ও চণ্ডীমঙ্গল গীত নামেও পরিচিত।
•চণ্ডীমঙ্গল কাব্যের শেষ কবি অকিঞ্চন চক্রবর্তী। অকিঞ্চন চক্রবর্তী মেদিনীপুরের ঘটাল মহকুমার বেঙ্গারাম গ্রামে বসবাস করতেন। অকিঞ্চন চক্রবর্তীর উপাধি ছিল কবীন্দ্র।

অন্নদামঙ্গল কাব্য:

দেবী অন্নদার গুণকীর্তন নিয়ে রচিত কাব্য অন্নদামঙ্গল কাব্য। এটি রচনা করেন ভারতচন্দ্র রায়গুণাকর। তাকে মধ্যযুগের শ্রেষ্ঠ কবি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। অন্নদামঙ্গল কাব্য তিনখণ্ডে বিভক্ত- (১) প্রথম খণ্ড শিবনারায়ণ অন্নদামঙ্গল। (২) দ্বিতীয় খণ্ড- বিদ্যাসুন্দর কালিকামঙ্গল; (৩) তৃতীয় খণ্ড-ভবানন্দ মানসিংহ অন্নদামঙ্গল।

প্রথম খণ্ড শিবনারায়ণ অন্নদামঙ্গল উপাখ্যানে সতীর দেহত্যাগ ও উমারূপে জন্মগ্রহণ, শিবের সাথে বিয়ে, ঘরকন্না ও অন্নপূর্ণা মূর্তিধারণ, পূঁজা প্রতিষ্ঠা প্রভৃতি পৌরাণিক কাহিনী বর্ণিত হয়েছে। প্রথম খণ্ডের প্রধান চরিত্র দেবতা শিব, উমা, হরিহোড়, ভবানন্দ, ঈশ্বরী পাটনি।

দ্বিতীয় খণ্ড বিদ্যাসুন্দর, কালিকামঙ্গল উপাখ্যানের প্রধান চরিত্র সুন্দর, বিদ্যা, দেবী কালি, রাজা বীরসিংহ, হীরা মালিনী। ভাষা, ছন্দ, কাহিনী, উপমার বিচারে তার রচিত বিদ্যাসুন্দর কাব্যে শ্রেষ্ঠত্বের দাবিদার। তৃতীয় খণ্ড মানসিংহ ভবানন্দ উপাখ্যানের প্রধান চরিত্র-মানসিংহ, ভবানন্দ, দেবী অন্নদা, সম্রাট জাহাঙ্গীর।

অন্নদামঙ্গল কাব্যের দুটি বিশেষ চরিত্র ঈশ্বরী পাটনী ও হীরা মালিনী।

অন্নদামঙ্গলের কবি:

• অন্নদামঙ্গল কাব্যের শ্রেষ্ঠ কবি ভারতচন্দ্র রায় মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি হিসেবে খ্যাত কাব্যধারার সর্বশেষ কবি ভারতচন্দ্র রায়গুণাকর। গুণাকর কবি ভারতচন্দ্রের উপাধি।

• ভারতচন্দ্র রায়গুণাকর বর্ধমান বিভাগের ভুরসুট পরগণার আধুনিক হাওড়া জেলার পেড়ো (পাণ্ডুয়া) গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ভারতচন্দ্রের সম্ভাব্য জন্ম ১৭০৫ সালে বলে ধরা হয়। রাজা কৃষ্ণরায়ের বংশে ভারতচন্দ্রের জন্ম।

• ভারতচন্দ্রের কবিজীবনের সূত্রপাত হয় দেবনান্দপুর গ্রামে অবস্থানকালে ‘সত্যনারায়ণ পাঁচালী রচনার মধ্যে দিয়ে। চল্লিশ বছর বয়সে ভারতচন্দ্র নবদ্বীপের রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায়ের সভাকবি নিযুক্ত হন। রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায় কবি ভারতচন্দ্র রায়ের কবিতার মুগ্ধ হয়ে কবিকে ‘গুণাকর’ উপাধিতে ভূষিত করেন। ভারতচন্দ্র মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের আদেশে ‘অন্নদামঙ্গল কাব্য’ রচনা করেন। কৃষ্ণচন্দ্র এ কাব্যে এত মুগ্ধ হন যে, এটি দরবারে গাওয়া হতো এবং এ কাব্য রচনার পর তিনি বর্তমান আকারে কালীপূজা প্রবর্তন করেন।
• ভারতচন্দ্রের প্রধান দুটি কাব্যগ্রন্থ হল ‘অন্নদামঙ্গল’ ও সত্য পীরের পাঁচালী’। ১৭৫৩ খ্রিষ্টাব্দে তিনি ‘অন্নদামঙ্গল কাব্য’ রচনা করেন। কবি ভারতচন্দ্র রচিত অন্নদামঙ্গল কাব্যের মোট পর্ব সংখ্যা ৮। তাঁর রচিত দুটি বিখ্যাত উক্তি হল- ‘মন্ত্রের সাধন কিংবা শরীর পতন’ এবং ‘আমার সন্তান যেন থাকে দুধে ভাতে’।
আরবি-ফারসি শব্দ ব্যবহার সম্পর্কে ভারতচন্দ্রের বিখ্যাত পঙক্তি:
“প্রাচীন পণ্ডিতগণ গিয়েছেন কয়ে।
যে হৌক সে হৌক ভাষা কাব্যরস লয়ে”।
• ভারতচন্দ্র রায় মৈথিলী কবি ভানুদত্তের ‘রসমঞ্জুরী’ কাব্যের অনুবাদও করেছিলেন। কবি ভারতচন্দ্র রায়ের অসমাপ্ত রচনা ‘চণ্ডীনাটক’।

 

কালিকামঙ্গল কাব্য:

অপূর্ব রূপ গুণান্বিত রাজকুমার সুন্দর এবং বীরসিংহের অতুলনীয়া সুন্দরী ও বিদূষী কন্যা বিদ্যার গুপ্ত প্রণয়কাহিনী কালিকামঙ্গল কাব্যের মূল উপজীব্য বিষয়। মূল কাহিনী কাশ্মীরের বিখ্যাত কবি বিলহন কর্তৃক তার ‘চৌরপঞ্চাশিকা’ কাবো সংস্কৃতে বিধৃত হয়েছিল। বিলহন একাদশ শতকে কবি। ক্রমে চৌরপঞ্চাশিকার কাহিনী বাংলায় এসে প্রণয়াকাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত হয়ে কালিকামঙ্গলে স্থান পেয়েছে।

কালিকামঙ্গলের কবিগণ:
•কালিকামঙ্গল বা বিদ্যাসুন্দরের আদি কবি হলেন কবি কঙ্ক। তিনি কিশোরগঞ্জ জেলার নদীর তীরে বিপ্র গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার জীবনের করুণ ও বিচিত্র কাহিনী অবলম্বনে রচিত লোকগাথা ‘কঙ্ক ও লীলা’ নামে ময়মনসিংহ গীতিকোষ স্থান পেয়েছে।
• বিদ্যাসুন্দরের কাহিনী নিয়ে শ্রীধর নামে একজন হিন্দু লেখকের রচনা প্রথম লেখা বলে অনুমিত। তিনি চট্টগ্রামের কবি। তিনি ষোল শতকের শুরুতে নুশরত শাহের নির্দেশ এ কাব্য রচনা করেন।
• অন্নদামঙ্গলের কবি ভারতচন্দ্র রায় শ্রেষ্ঠমানের বিদ্যাসুন্দর কাব্যের রচয়িতা। তার কালিকামঙ্গলে তিনি অশ্লীলরূপে নারী মিলনের বর্ণনা দিয়েছেন এবং নারীদের সম্পর্কে অনেক স্থুল রসিকতা করেছেন। সুন্দর নামে এক বিদেশি বিদ্যাশিক্ষার্থীর সাথে বিদ্যা নামে এক বাঙালি কন্যার প্রণয় ও মিলনের কাহিনী এ কাব্যের উপজীব্য।
• সাবিরিদ খান (শাহ বারিদ খান) ছিলেন ‘বিদ্যাসুন্দর’ কাব্যের রচয়িতা। তিনি চট্টগ্রাম অঞ্চলের কবি ছিলেন। তিনি ‘রসূল বিজয়’ কাব্যও রচনা করেন। হযরত মুহম্মদ (সা:) এর রাজ্য জয়, তার মাহাত্ম্য ঘোষণা হচ্ছে ‘রাসূল বিজয়’ গ্রন্থের বক্তব্য।
• কবি গোবিন্দদাস ১৫৯৫ খ্রিষ্টাব্দে কালিকামঙ্গল কাব্য রচনা করেন।
• রামপ্রসাদ সেন কালিকামঙ্গলের বিশিষ্ট কবি। কবি রামপ্রসাদ ১৭২০ খ্রিষ্টাব্দে চব্বিশ পরগনা জেলার হালি শহরের নিকটবর্তী কুমারহট্ট গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। নবদ্বীপের রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রামপ্রসাদকে ‘কবিরঞ্জন’ উপাধি দেন। কবি রামপ্রসাদের কাব্যের নাম ‘কবিরঞ্জন’। রামপ্রসাদ শ্যামসঙ্গীত রচনায়ও অপরিসীম কৃতিত্ব দেখিয়েছেন।

অন্যান্য মঙ্গল কাব্য:
• অন্যান্য মঙ্গল কাব্যগুলোর শিবায়ন বা শিবমঙ্গল, শীতলামঙ্গল, ষষ্ঠীমঙ্গল, সারদামঙ্গল, রায়মঙ্গল, গঙ্গামঙ্গল, পঞ্জাননমঙ্গল, অনাদিমঙ্গল, তীর্থমঙ্গল প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য।

শিবায়নবন্ধ শিবমঙ্গল কাব্য:
• শিব প্রাগবৈদিক দেবতা। লৌকিক দেবতা হিসেবে তার বিবর্তন ঘটেছে। পৌরাণিক মৌলিক উপাদান মিশ্রিত হয়ে শিবায়ন বা শিবমঙ্গল কাব্য রচিত। মনে করা হয় কবি রামকৃষ্ণ রায় শিবমঙ্গল কাব্যের আদি কবি। রামকৃষ্ণ রায় রচিত কাব্যের নাম ‘শিবের মঙ্গল’।
• কবি কঙ্ক আনুমানিক ১৬৮০ খ্রিষ্টাব্দে ‘শিবমঙ্গল’ কাব্য রচনা করেন।

• কবি রামেশ্বর ভট্টাচার্য আঠার শতকের প্রথম দিকে ‘শিবায়ন’ বা ‘শিব-কীর্তন’ নামে কাব্য রচনা করেন।
ধর্মমঙ্গল কাব্য:
ধর্মঠাকুর নামে দেবতার মাহাত্ম্য প্রচার ও পূজার ঘটনা নিয়ে রচিত ধর্মমঙ্গল কাব্য। হিন্দু নিচু শ্রেণির (ডোমসমাজ) দেবতা ধর্মঠাকুর। রাঢ়দেশে ধর্মঠাকুর এখনও জাগ্রত দেবতা। আঞ্চলিক হলেও অন্যান্য মঙ্গল পাচালির চেয়ে ধর্মমঙ্গল কাব্যের চাহিদা ও জনপ্রিয়তা ছিল অধিক। অসংখ্য অব্রাহ্মণ-চণ্ডাল-ব্রাহ্মণ রচনা করেন এ কাব্য। ধর্মঠাকুরই একমাত্র দেবতা যাতে সর্বশ্রেণির সর্বজনের অধিকার ও শ্রদ্ধা ছিল। কাহিনীতে রয়েছে ধর্মঠাকুরের আসল পরিচয়: সূর্য তার অনুগত, সন্তানদের তার আয়ত্তে¡, জলবর্ষণ তার কাজ, চক্ষুরোগ নিরাময় তার কৃপা, তার দেয়া দণ্ড কুষ্ঠরোগ, ধবল রূপ তার প্রিয়। সাধারণত একটি শিলাখণ্ডই (কূর্মমূর্তি) ধর্ম-প্রতীকরুপে পূজা পায়।

ধর্মমঙ্গল কাব্যের কাহিনী দুটি- (১) রাজা হরিশ্চন্দ্রের কাহিনী; (২) লাউসেনের কাহিনী। ‘রাজা হরিশ্চন্দ্রের কাহিনী’র প্রধান চরিত্র রাজা হরিশ্চন্দ্র, বা লুইধর। ‘লাউসেনের কাহিনী’র চরিত্র কর্ণসে, রঞ্জাবতি, ধর্মঠাকুর, লাউসেন, মাহমুদ।

ধর্মমঙ্গলের কবি:
• ধর্মমঙ্গল কাব্যের আদিকবি ময়ুরভট্ট। তিনি সতের শতকের কবি ছিলেন। ময়ুরভট্ট রচিত কাব্যটি হচ্ছে “শ্রীধর্মপুরাণ”। তবে তার রচনার একটি পদও পাওয়া যায়নি।
• ধর্মমঙ্গলের দ্বিতীয় কবি আদি রূপরাম। কবি মাণিক গঙ্গুলিই তাকে স্মরণ করে পদ রচনা করেন। তার কোন পুঁথি পাওয়া যায়নি।
• ধর্মমঙ্গলের আরেক কবি খেলারাম চক্রবর্তী। ধর্মমঙ্গল কাব্যের একজন অন্যতম কবি মানিকরাম গাঙ্গুলি। মানিকরামের সমসাময়িক আরেকজন কবি দ্বিতীয় রূপরাম। কবি দ্বিতীয় রূপরাম ১৫৯০ খ্রিষ্টাব্দে তার কাব্য রচনা করেন।
ধর্মমঙ্গলের অন্যতম কবি শ্যামপÐিত। শ্যাম পণ্ডিত রচিত কাব্যের নাম ‘নরঞ্জন মঙ্গল’।
রামদাস আদক রচিত কাব্যের নাম অনাদিমঙ্গল। ১৬৬২ খ্রিষ্টাব্দে তার কাব্য প্রথম গীত হয়।
• কবি ঘনরাম অষ্টাদশ শতকের ধর্মমঙ্গলের সর্বশ্রেষ্ঠ কবি। ১৭১২ খ্রিষ্টাব্দে ঘনরাম চক্রবর্তীর কাব্য রচনা শেষ হয়। বর্ধমান জেলার কৃষ্ণপুর গ্রামে কবি ঘনরাম চক্রবর্তী জন্মগ্রহণ করেন। ধর্মঠাকুরের অনুগৃহীত লাউসেনের কাহিনীই ঘনরাম চক্রবর্তীর কাব্যের উপজীব্য।

বৈষ্ণব পদাবলি:
বৈষ্ণব পদাবলী বাংলা কবিতার অন্যতম শ্রেষ্ঠ নিদর্শন। এটি মধ্যযুগের সাহিত্যের সবচাইতে রসোত্তীর্ণ ও সার্থক সাহিত্যকর্ম।
শ্রী চৈতন্যদেব (১৪৮৬-১৫৩৩) প্রচার করেন বৈষ্ণব ধর্ম এবং এরপর থেকে বাংলা কবিতায় বৈষ্ণব দর্শন স্থান পেতে থাকে। এর বিষয়বস্তু হল রাধা ও কৃষ্ণের প্রেমলীলা। এতে মূলত স্রষ্টা ও সৃষ্টির মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক দেখানো হয়েছে। এতে কৃষ্ণ পরমাত্মার প্রতীক আর রাধা জীবাত্মার প্রতীক।
চেতন্যদেব ধর্মপ্রচার করেছিলেন বাংলা ভাষায়। তার ধর্মে শাস্ত্রের কথাও ছিল সামান্য। বরং জীবে দয়া এবং নামে রুচি অর্থাৎ নাম জপের কথাই তিনি জোর দিয়ে বলেছিলেন।
গীতগোবিন্দ রচয়িতা বার শতকের কবি জয়দেব প্রথম পদাবলি শব্দটি ব্যবহার করেন। মধ্যযুগের গীতিকবিতার বা গীতিময় রচনার বিশিষ্ট রূপকে পদাবলি বলা হতো। জয়দেব বৈষ্ণব নন এবং তিনি চৈতন্যের তিনশত বছর পূর্বে জন্মগ্রহণ করেন। নীলাচলে অসুস্থবস্থায় চৈতন্যদেব তিনজন কবির পদ আস্বাদন করে আনন্দ পেতেন- জয়দেব, বিদ্যাপতি ও চণ্ডীদাস।

• বৈষ্ণব পদাবলির শ্রেষ্ঠ কবি ৪ জন-
১. বিদ্যাপতি (১৩৮০-১৪৬০ খ্রি:):
বিদ্যাপতি ছিলেন মিথিলার রাজা শিবসিংহের সভা কবি। তার উপাধি ছিল কবি কণ্ঠহার, অভিনব জয়দেব ও মিথিলার কোকিল। তিনি ব্রজবুলি ভাষায় পদ রচনা করেন। ব্রজবুলি হল হিন্দি, বাংলা ও প্রাকৃত ভাষার মিশ্রণ। প্রায় হাজার খানেক কদ বিদ্যাপতির নামে প্রচলিত, তবে জর্জ গ্রিয়ার্সন বিদ্যাপতির মৈথিল্য পদ সংগ্রহের জন্য গিয়ে মাত্র ৭৬টি পদ পেয়েছিলেন। বাংলাদেশে ব্রজবুলিতে সর্বশেষ পদ রচনার নিদর্শন হল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলী’। তবে রবীন্দ্রনাথের তরুণ বয়সের এ রচনা ঠিক বৈষ্ণবীয় ব্রজবুলি হয়েছে বলে মনে হয় না। বিদ্যাপতির বিখ্যাত বিরহ বিষয়ক পদ-
এ সখি হামারি দুখের নাহি ওর।
এ ভরা বাদর মাহ ভাদর।
শূন্য মন্দির মোর

২. চণ্ডীদাস:
চণ্ডীদাসের সময়কাল চৌদ্দ শতকের শেষার্ধ থেকে পনের শতকের প্রথমার্ধ। তিনি পূর্ব বাংলার কবি ছিলেন। বাংলা সাহিত্যে তিনি দ্বিজ চণ্ডীদাস নামে খ্যাত। তিনি খাঁটি বাংলা ভাষারয় পদ রচনা করেন। তিনি বৈষ্ণব পদাবলির প্রথম কবি। রবীন্দ্রনাথ চণ্ডীদাসকে বলেছেন দু:খের কবি। কারণ তার কবিতায় রয়েছে অতলান্ত বেদনার সুর।

চণ্ডীদাসের বিখ্যাত পঙ্্ক্তি
১. শুনহ মানুষ ভাই।
সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই।

২. সই, কেমনে ধারিব হিয়া।
আমার বঁধূয়া আন বাড়ী যায়।
আমার আঙ্গিনা দিয়া।

৩. গোবিন্দ দাস:
বিদ্যাপতির অনুসারী ছিলেন গোবিন্দ দাস। গোবিন্দ দাস ব্রজবুলি ভাষায় পদ রচনা করেন। গোবিন্দ দাস ষোল শতকের কবি। তার বিখ্যাত রাধা রূপ বিষয়ক পদ হল-
“যাঁহা যাঁহা তনু তনু জ্যোতি।
তাঁহা তাঁহা বিজুরি চমকময় হোতি।

৪. জ্ঞানদাস:
চণ্ডীদাসের অনুসারী ছিলেন জ্ঞানদাস। জ্ঞানদাস ষোল শতকের কবি। চৈতন্যপরবর্তী পদাবলি সাহিত্যের বিস্তৃতি ও গভীরতা সৃষ্টিতে তার অবদান অসামান্য। তার জন্মস্থান বর্ধমান জেলার কাটোয়া এলাকার কাঁদড়া গ্রামে। কাঁদড়াতে জ্ঞানদাসের মঠও আছে এবং তার তিরোধান উপলক্ষ্যে সেখানে মেলা-উৎসব হয়।
তার বিখ্যাত কৃষ্ণানুরাগ বিষয়ক পদ হল-
রূপ লাগি আখি ঝুরে গুণে মন ভোর।
প্রতি অঙ্গ লাগি কান্দে প্রতি অঙ্গ মোর।

তথ্যটি গুরুত্বপূর্ণ মনে হলে শেয়ার করুন

More News Of This Category