November 29, 2023, 12:01 pm
গণমাধ্যমকর্মীদের বেতন পরিশোধ, ছুটি নির্ধারণ এবং ন্যায্য পাওনা নিষ্পত্তির জন্য প্রয়োজনে আদালত গঠনের বিধান রেখে আইন করছে সরকার। এ লক্ষ্যে সোমবার শুরু হওয়া একাদশ জাতীয় সংসদের ১৭তম অধিবেশনের প্রথম দিনেই বিল তোলা হয়েছে।
‘গণমাধ্যমকর্মী (চাকরির শর্তাবলী) বিল-২০২২’ সোমবার সংসদে উত্থাপন করেন তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী হাছান মাহমুদ। পরে সেটি ৬০ দিনের মধ্যে পরীক্ষা করে সংসদে প্রতিবেদন দিতে তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে পাঠানো হয়।
বিলে বলা হয়, গণমাধ্যমকর্মীর বেতনকাল এক মাসের বেশি হবে না। পরবর্তী মাসের সাত কর্মদিবসের মধ্যে তাকে বেতন পরিশোধ করতে হবে। গণমাধ্যমকর্মীদের ন্যূনতম বেতনকাঠামো (ওয়েজ বোর্ড) প্রতি পাঁচ বছর অন্তর সংস্কার হবে। সংবাদপত্র, সংবাদ সংস্থা, বেসরকারি টেলিভিশন, বেতার ও নিবন্ধিত অনলাইন মাধ্যমের জন্য প্রয়োজনে পৃথক বেতনকাঠামো নির্ধারণ করবে ওয়েজ বোর্ড।
প্রস্তাবিত আইনে বলা আছে, গণমাধ্যমে পূর্ণকালীন সাংবাদিক, কর্মচারী এবং নিবন্ধিত সংবাদপত্রের মালিকানাধীন ছাপাখানাসহ নিবন্ধিত অনলাইন গণমাধ্যমে নিয়োজিত কর্মীদের ‘গণমাধ্যমকর্মী’ বলা হবে।
গণমাধ্যমকর্মীদের তিনটি বিভাগ করা হয়েছে বিলে। সেগুলো হলো- অস্থায়ী বা সাময়িক, শিক্ষানবিশ ও স্থায়ী। বিলে বলা হয়েছে, গণমাধ্যমকর্মীকে সপ্তাহে অন্যূন ৪৮ ঘণ্টা কাজ করতে হবে। এর বেশি কাজ করাতে চাইলে অধিকাল (ওভারটাইম) ভাতা দিতে হবে।
গণমাধ্যমকর্মীদের এসব বিষয় এতদিন ‘দ্য নিউজপেপার এমপ্লয়িজ (চাকরির শর্তাবলী) আইন- ১৯৭৪’-এর আওতায় পরিচালিত হতো। এর সঙ্গে শ্রম আইনের কিছু বিষয় সাংঘর্ষিক হচ্ছিল। পরে সাংবাদিকদের শ্রম আইনের আওতায় নিয়ে যাওয়া হয় এবং তাদের শ্রমিক হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা হয়। প্রস্তাবিত বিল পাস হলে গণমাধ্যমকর্মীরা শ্রমিক নয়, গণমাধ্যমকর্মী হিসেবে গণ্য হবেন।
‘দ্য নিউজপেপার এমপ্লয়িজ (চাকরির শর্তাবলী)’ আইনে সাংবাদিক, প্রেস শ্রমিক ও প্রেস কর্মচারীদের চাকরির শর্ত, আর্থিক বিষয় ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা নির্ধারণ করা ছিল। সরকার ওই আইনকে রহিত করে সব শ্রমিকের জন্য ২০০৬ সালে ‘শ্রম আইন’ প্রণয়ন করে, যাতে সংবাদপত্রের সাংবাদিক, প্রেস শ্রমিক ও প্রেস কর্মচারীদের বিষয়গুলোও অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
নতুন আইন পাস হলে একজন গণমাধ্যমকর্মী বছরে ১৫ দিন নৈমিত্তিক ছুটি পাবেন। এ ছাড়া প্রতি ১১ দিনে এক দিন অর্জিত ছুটি অর্জন করবেন। এই ছুটি ভোগ না করলে তা জমা থাকবে এবং চাকরি শেষে সর্বোচ্চ ১০০ দিন নগদায়নের সুবিধা পাবেন। চিকিৎসকের প্রত্যয়ন সাপেক্ষে একজন গণমাধ্যমকর্মী চাকরির মেয়াদের অন্যূন ১৮ ভাগের এক ভাগ সময় পূর্ণ বেতনে অসুস্থতাজনিত ছুটি পাবেন।
বিলে বলা আছে, কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে একজন গণমাধ্যমকর্মী পূর্ণ বেতনে এককালীন বা একাধিকবার অনূর্ধ্ব ১০ দিন উৎসব ছুটি ভোগ করতে পারবেন। তিন বছর পরপর ১৫ দিনের শ্রান্তি বিনোদন ছুটির সুযোগ থাকবে। প্রতি বছর একজন কর্মী এককালীন বা একাধিকবার অনূর্ধ্ব ১০ দিনের উৎসব ছুটি ভোগ করতে পারবেন। উৎসবের দিনে কাজ করালে প্রতি কার্যদিবসের জন্য দুদিনের মূল বেতন বা দুদিনের বিকল্প ছুটি মঞ্জুর করতে হবে।
এক বছর চাকরি করার পর ভবিষ্য তহবিলে কর্মী ও মালিকের আট থেকে ১০ শতাংশ চাঁদার কথা বিলে বলা হয়েছে। বিলে প্রত্যেক প্রতিষ্ঠানে গণমাধ্যমকর্মী এবং মালিকের মধ্যে সম্পর্কোন্নয়নের জন্য ‘গণমাধ্যম কর্মী কল্যাণ সমিতি’ গঠনেরও বিধান রাখা হয়েছে।
প্রস্তাবিত আইনে দেনা-পাওনা নিয়ে বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য এক বা একাধিক বিভাগীয় এলাকার জন্য গণমাধ্যম আদালত স্থাপনের সুযোগ রাখা হয়েছে। এই আদালতে একজন চেয়ারম্যান ও দুজন সদস্য থাকবেন। কর্মরত জেলা জজদের মধ্যে একজন চেয়ারম্যান হবেন। দুই সদস্যের একজন হবেন গণমাধ্যম মালিক, আরেকজন গণমাধ্যমকর্মী।
প্রস্তাবিত আইনে বলা আছে, গণমাধ্যম আদালত ফৌজদারি কার্যবিধিতে বর্ণিত সংক্ষিপ্ত বিচার পদ্ধতি অনুসরণ করবে। প্রথম শ্রেণির জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট বা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেটের ওপর ন্যস্ত সব ক্ষমতা গণমাধ্যম আদালতেরও থাকবে।
বিলে গণমাধ্যম আপিল আদালতেরও বিধান রাখা হয়েছে। এর চেয়ারম্যান হবেন হাইকোর্ট বিভাগে কর্মরত বা অবসরপ্রাপ্ত একজন বিচারক বা অতিরিক্ত বিচারক। চেয়ারম্যানকে পরামর্শ দিতে সরকার এক বা একাধিক সদস্য নিয়োগ করতে পারবে। সদস্যরা আসবেন তিন বছর কর্মরত আছেন বা ছিলেন এমন জেলা জজদের মধ্য থেকে।
বিলে বলা হয়েছে, গণমাধ্যম আদালতের আদেশ পালনে অস্বীকার করলে বা ব্যর্থ হলে তিন মাসের জেল বা অনূর্ধ্ব পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা হবে। কোনো গণমাধ্যম মালিক নারী কর্মীকে প্রসূতি কল্যাণ সুবিধা না দিলে সেই মালিককে ২৫ হাজার টাকা দণ্ড দেয়া যাবে। ন্যূনতম হারের কম বেতন দিলে এক বছর থেকে পাঁচ বছর জেলের বিধান রাখা হয়েছে।
কোনো গণমাধ্যমকর্মী আদালতে মিথ্যা বিবৃতি দিলে তার ৫০ হাজার টাকা জরিমানা অনাদায়ে তিন মাসের জেল হবে। আবার গণমাধ্যম মালিক মিথ্যা বিবৃতি দিলে অনূর্ধ্ব পাঁচ লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা তিন মাসের কারাদণ্ড হবে। মালিকের পক্ষ থেকে অন্যায় আচরণ হলে ৫০ হাজার টাকা জরিমানা অনাদায়ে ছয় মাসের জেল হবে।
এক বছর চাকরিরত অবস্থায় কোনো গণমাধ্যমকর্মী মারা গেলে মৃতের মনোনীত ব্যক্তি বা তার উত্তরাধিকারীকে কর্মীর পূর্ণ বছর বা ছয় মাসের অধিক সময় চাকরির জন্য ক্ষতিপূরণ হিসেবে ৩০ দিনের এবং কর্মরত বা কর্মকালীন দুর্ঘটনার কারণে ৪৫ দিনের বেতন দিতে হবে।
কোনো স্থায়ী কর্মী ৩০ দিনের নোটিশ ও অস্থায়ী কর্মী ১৫ দিনের নোটিশে চাকরিতে ইস্তফা দিতে পারবেন। আর কোনো গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠান অতিরিক্ত কর্মী ছাঁটাই করতে চাইলে সরকারকে লিখিতভাবে জানাতে হবে। ছাঁটাই করতে হলে কর্মীকে এক মাসের লিখিত নোটিশ অথবা এক মাসের মূল বেতন দিতে হবে। এ ছাড়া ক্ষতিপূরণ হিসেবে প্রতি বছর চাকরির জন্য ৩০ দিনের মূল বেতন দিতে হবে।
সূত্র: অনলাইন নিউজ